বিএনএ,ঢাকা: বিএনএ নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ধারাবাহিক নির্বাচনী হালচাল প্রচার করছে। এতে ১৯৯১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর আসনভিত্তিক সাংগঠনিক হালচাল তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিএনএ নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম। আজ থাকছে নোয়াখালী-৫ আসনের হালচাল।
প্রসঙ্গত, অনেকের কাছে এই আসনটির সংসদ সদস্যদের নিয়ে বিভ্রান্ত বা খটকা লাগতে পারে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুয়ায়ি জাতীয় সংসদের ২৭২তম সংসদীয় আসনটি নোয়াখালী-৫ হিসাবে উল্লেখ রয়েছে। ১৯৭৩ সালের প্রথম এবং ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনটি নোয়াখালী ৬ নামে পরিচিত ছিল । ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে ২০০১ পর্যন্ত এটি নোয়াখালী-৪ নামকরণ হয় । ২০০৮ সালে সীমানা পরিবর্তন হওয়ার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত আসনটি তৃতীয়বারের মতো নাম পরিবর্তন করে নোয়াখালী- ৫ হিসাবে পরিচয় বহন করছে। ২৭২ তম সংসদীয় আসন থেকে এই পর্যন্ত যারা নির্বাচিত হয়েছেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছেন তার ভিত্তিতে বিএনএ নিউজ টুয়েন্টি ফোর এর গবেষণা টিম সেইসব সংসদ সদস্যেদের তালিকা নির্বাচনী তথ্য-উপাত্ত, এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুয়ায়ি জাতীয় সংসদের ২৭২তম নোয়াখালী-৫ সংসদীয় আসনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৬৭ হাজার ৫ শত ৫ জন। ভোট প্রদান করেন ৯২ হাজার ৯৯ জন। নির্বাচনে বিএনপির মোঃ শাজাহান বিজয়ী হন। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ৩৩ হাজার ৩ শত ৩৯ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের গোলাম মহিউদ্দিন লাতু। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ২৯ হাজার ২শত ৬১ ভোট ।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দল এই নির্বাচন শুধু বর্জন করে ক্ষান্ত হয়নি, প্রতিহতও করে। নির্বাচনে বিএনপি,ফ্রিডম পার্টি এবং কিছু নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল, অখ্যাত ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। এই নির্বাচনে বিএনপির মোঃ শাজাহানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত এই সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ হওয়ার পর এই সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৩ জন। ভোট প্রদান করেন ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩ শত ২৪ জন। নির্বাচনে বিএনপির মোঃ শাজাহান বিজয়ী হন। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ৬১ হাজার ৬ শত ৩২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের খায়রুল আনাম সেলিম। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৫৩ হাজার ৪ শত ১৩ ভোট।
২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯ শত ৭৮ জন। ভোট প্রদান করেন ২ লাখ ১ হাজার ৮ শত ৯১ জন। নির্বাচনে বিএনপির মোঃ শাজাহান বিজয়ী হন। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ১২ হাজার ৯৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের গোলাম মহিউদ্দিন লাতু। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৮৩ হাজার ৯ শত ৯৮ ভোট।
২০০৮ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে সীমানা পুণ:নির্ধারনের পর নোয়াখালী- ৫ সংসদীয় আসনটি কোম্পানিগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলা নিযে গঠিত।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৬২ হাজার ২ শত ২১ জন। ভোট প্রদান করেন ২ লাখ ২৫ হাজার ৩ শত ৭৮ জন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ১২ হাজার ৫ শত ৭৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির মওদুদ আহমদ । ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ১১ হাজার ২ শত ৪ ভোট।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ওবায়দুল কাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে র্নিবাচনের দাবিতে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এই নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেনি।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৩ লাখ ৩১ হাজার ৭ শত ৯৩ জন। ভোট প্রদান করেন ২ লাখ ৭২ হাজার ৬ শত ২৩ জন।
নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন ৮ জন। নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের, ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপির মওদুদ আহমদ, লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম , হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আবু নাছের, আপেল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী জুলফিকার হায়দার, টেলিভিশন প্রতীকে ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ এর মমতাজ বেগম , চেয়ার প্রতীকে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মোহাম্মদ সামছুদ্দোহা এবং মই প্রতীকে সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের সিরাজ উল্যাহ প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ২ লাখ ৫২ হাজার ৭ শত ৪৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির মওদুদ আহমদ। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান মাত্র ১০ হাজার ৯ শত ৭০ ভোট।
কারচুপির অভিযোগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বর্জন ও ফলাফল প্রত্যাখান করে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তমও অষ্টম সংসদে বিএনপি এবং নবম ,দশম ও একাদশ সংসদে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনএ নিউজ টুয়েন্টি ফোর এর গবেষণা টিম দৈবচয়ন পদ্ধতিতে সারাদেশে জরিপ চালায়। জরিপে অংশগ্রহণকারি বেশীরভাগ ভোটার ১৯৯১ সালের পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০১ সালের অষ্টম ও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরেপক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তারই ভিত্তিতে বিএনএ নিউজ টুয়েন্টি ফোর নোয়াখালী-৫ আসনে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম এই ৪টি নির্বাচনের প্রদত্ত ভোটের পরিসংখ্যানকে মানদন্ড ধরে আওয়ামী লীগ,বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত ইসলামীর সাংগঠনিক শক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি কল্পানুমান উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৯১ সালের পঞ্চম থেকে অষ্টম সংসদ নির্বাচন নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ২৭২তম আসনটি নোয়াখালী ৪ হিসাবে পরিচিত ছিল।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৩৩.৩১% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩১.৭৭%, বিএনপি ৩৬.২০%, জাতীয় পাটি ১২.৮০%, জামায়াত ইসলামী ১৭.৬১% স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ১.৬২% ভোট পায়।
১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৬৩.০৫% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩৯.৭৬%, বিএনপি ৪৫.৮৮% জাতীয় পাটি ৫.০৮%, জামায়াত ইসলামী ৮.১৭% স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ১.১১% ভোট পায়।
২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৫৯.৫৬% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪১.৬১%, ৪ দলীয় জোট ৫৫.৫২%, জাতীয় পাটি ২.২৬% স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ০.৬১% ভোট পায়।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৮৫.৯৫% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ১৪ দলীয় জোট ৪৯.৯৫%, ৪ দলীয় জোট ৪৯.৩৮% স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ০.৭১% ভোট পায়।
নোয়াখালী-৫ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের । দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন পাবেন তা নিশ্চিত।
একাদশ সংসদের বিএনপির প্রার্থী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ২০২১ সালের ১৬ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের স্ত্রী হাসনা জসীম উদ্দিন মওদুদ।
তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষনে দেখা যায়, সংসদের ২৭২ তম এই আসনটি স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দখলে থাকলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আসনটির পটও পরিবর্তন হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদে বিএনপি এবং পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি এই আসনে প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে এই আসনটি আওয়ামী লীগ পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুম আহমেদের কাছে হেরে যান আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তখন এই আসনটির পরিচয় ছিল নোয়াখালী-৪ হিসাবে।
২০০৮ সালে সীমানা পরিবর্তনের পর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী ৫ নামে খ্যাত এই আসনটিতে বিএনপির মওদুদ আহমেদকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের। পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনেও নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। টানা ১৫ বছর ধরে তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। বিশেষ করে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন নোয়াখালীর অন্যান্য সংসদী এলাকার চেয়ে সবচেয়ে বেশি হয়েছে বলে মনে করেন এলাকার ভোটারগণ। তাছাড়া দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করেছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
অপরদিকে টানা ১৫ বছর ক্ষমতা বলয়ের বাহিরে বিএনপি। সেকারণে সাংগঠনিক দিক থেকে বেশ নড়েবড়ে বিএনপি। তা ছাড়া জনপ্রিয় নেতা সংকট রয়েছে। সব মিলিয়ে এই আসনে নির্ভার রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হলে জাতীয় সংসদের ২৭২ তম সংসদীয় আসন (নোয়াখালী-৫) আসনটিতে আওয়ামী লীগ আবারও বিজয়ী হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনএ নিউজ/ শাম্মী, রেহানা, ওজি, ওয়াইএইচ