বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র একটি প্রামাণিক গ্রন্থ যা ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত এ তথ্য ভাণ্ডারে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষের অজানা। বিশেষ করে এ প্রজন্ম জানেই না কত রক্ত, কত কষ্ট, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্জন ও উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাঙ্গালি জাতি বিলীন হয়ে যেত! এমনটাই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানাতে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে।
আজ প্রকাশিত হলো
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৪
১০ জুলাই, ১৯৭১
রাওয়ালপিণ্ডি থেকে দুটো পত্র পৌঁছেছে লণ্ডনে। সরকারীভাবে সরকারী চিঠি। এগুলো নাকি প্রতিবাদলিপি। কিন্তু কিসের প্রতিবাদ? দুনিয়া তাজ্জব হয়ে গিয়েছে খবরটা শুনে। পাকিস্তানী জল্লাদ সরকার বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখে জানিয়েছে, বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে বৃটেনের সংবাদপত্রে পাকিস্তানবিরোধী প্রচার চলছে- এ প্রচার বন্ধ করার ব্যবস্থা হোক।
বিশ্ববাসীর মনে স্বভাবতই দুটো প্রশ্ন জেগেছে। বাংলাদেশ নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করার পরেও যে পাকিস্তান স্বৈরাচারী শাসকচক্র অতীতের রেশ ধরে বাংলাদেশের ঘটনাকে এখনও আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বোঝাতে চেষ্টা করছে। আর শুধুমাত্র অস্ত্রপাতির জোরে বলে বেড়াচ্ছে যে বাংলাদেশ তাদের দখলে রয়েছে। তারা বৃটেনের খবরের কাগজগুলি কি লিখছে না লিখছে তার ওপর খবরদারি করতে চাইছে কোন লজ্জায়? এটা হতে পারে প্রথম প্রশ্ন।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা ভিন্ন ব্যাপার থেকে এসেছে। পাকিস্তানী জল্লাদেরা নিজেদের হাতে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করা ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম নগরীতে রাজমিস্ত্রী দিয়ে দুটো-চারটে দালানকৌটা মেরামত করিয়ে আর রং ফিরিয়ে, নিজেদের হাতে খুন করা হাজার হাজার নরনারী-শিশুর গলিত লাশ গুম করে সাফাই-সাক্ষীর মারফত প্রমাণ করার চেষ্টায় ছিল যে, পাকিস্তানী ফৌজের লোকেরা বেকসুর-মাসুম; তারা দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে জান কোরবান করে দিয়েছে আর ফৌজি কর্তাব্যক্তিরা করুণার বড় বড় থলে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বসে আছে জনসংযোগ দফতর হাট খুলে। ফল এতে উল্টোই হয়েছে। সাংবাদিকরা অবরুদ্ধ নগরীগুলিতে ঢুকবার সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন এবং ফাঁস করে দিয়েছেন পাকিস্তানী জল্লাদদের সমস্ত গোমর।
শেষ রক্ষা করার জন্যে, সত্যের বিশ্বপরিব্যাপ্ত অগ্নিশিখাগুলিকে ঢাকা দেবার জন্যে পাকিস্তানী জল্লাদেরা এখন চেষ্টা করছে বিভিন্ন দেশের সরকারকে দিয়ে কিছু একটা করাতে। কিন্তু এদের মাথায় কি এ কথাটা ঢুকছে না যে, যে হাত দিয়ে এরা সত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ লিখছে, তা বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র নরনারী-শিশুর রক্তে রঞ্জিত সে রক্তের দাগ লেগে যাচ্ছে এদের চিঠিপত্রেও। তবে দুনিয়ার সামনে উপরোক্ত দুটো প্রশ্নের একটাই জবাব রয়েছে। দু’কান কাটা রাস্তার মাঝ দিয়েই চলে। আসামীর কাঠগড়ায় উঠে আবোল-তাবোল বকে পাগলের ভান করে। সত্যকে চাপা দেবার জন্যে পাকিস্তানী জল্লাদেরা কম চেষ্টা করেনি, এরা ২৫শে মার্চে নৈশ হামলা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা নগরীতে সমাগত সমস্ত বিদেশী সাংবাদিকদের হোটেলের কামরায় আটকে রেখেছিল। তা সত্ত্বেও সেই অবরোধ ভেদ করে সাংবাদিকরা পাকিস্তানী জল্লাদদের নারকীয় কাণ্ডের যে তথ্য আর ছবি নিয়েছিল, সেই সব তথ্য আর ছবি কেড়ে নিয়েছিল করাচী বিমানবন্দরে।
আন্তর্জাতিক রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীকে এরা ঢুকতে দেয়নি, পাছে পাপ প্রকাশ পেয়ে যায় এই চিন্তায়। এরা বাংলাদেশের যেসব খবরের কাগজের অফিসকে দালান সমেত পুড়িয়ে ছাই করেনি, তাদের ওপর জঙ্গী আইনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কোন ফাঁকে যাতে বাংলাদেশ থেকে খবর বাইরে যেতে না পারে সেজন্যে এরা বিদেশীদের জন্যে নির্ধারিত কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে বুটের তলায় মাড়াতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু সত্যকে চাপা দেওয়া যায়নি। পাকিস্তানী জল্লাদেরা ভেবেছিল, দিন চলে যাবে একরকম করে এবং দুনিয়ার মানুষ আস্তে আস্তে ভুলে যাবে।
(‘জামিল শারাফি’ ছদ্মনামে রণেশ দাশগুপ্ত রচিত)
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র -৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ৯৩) চলবে।
আগের পর্ব সমূহ :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৪৯
গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী