23 C
আবহাওয়া
১১:২৬ অপরাহ্ণ - ডিসেম্বর ৩, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » চরমপন্থি আমানুল্লাহর নেতৃত্বে খুন, চুক্তি ৫ কোটি?

চরমপন্থি আমানুল্লাহর নেতৃত্বে খুন, চুক্তি ৫ কোটি?

চরমপন্থি আমানুল্লাহর নেতৃত্বে খুন, চুক্তি ৫ কোটি?

বিএনএ, ঢাকা: ঝিনাইদহ-৪ সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম (আনার) ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে পরিকল্পিত হত্যার শিকার হয়েছেন তিনি। এই বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের পুলিশ অনেকটা নিশ্চিত। কিন্তু তার মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি। ফলে হত্যাকান্ডের ধোঁয়াশা কাটেনি। নিউটাউনের ফ্ল্যাটের যে কক্ষে মরদেহ বা খন্ডিত অংশ রয়েছে বলে ভারতে পুলিশ ধারণা করছে, সেই কক্ষটি বায়োমেট্রিকভাবে তালাবদ্ধ। সেই সেন্সর লক করা ঘরকে ঘিরে রহস্য দেখা দিয়েছে। এখনো পর্যন্ত সংসদ সদস্যের মরদেহের সন্ধান পায়নি। ফলে খুনের ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি।

তবে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের হত্যাকান্ডের সঙ্গে চরমপন্থিদের একটি গ্রুপ জড়িত। এর নেপথ্য কারণ হিসাবে সোনা ও মাদক চোরাচালানের লেনদেন ও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সামনে এসেছে।

তাছাড়া সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম এক সময় নিজেও চরমপন্থি নেতা ছিলেন। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামিও ছিলেন এমপি আনার। তার রাজনৈতিক উত্থান ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকেই। ১৯৮৬ সালের দিকে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে আনার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্ত পথে চোরাচালান করতেন তিনি।

YouTube player

ওই সময় কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী।

ওই টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

এই মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও বনে যান। ১৯৯১ সালে আনার ঝিনাইদহের আরেক চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্বর্ণের বড় বড় চালান রাজধানী থেকে বাঘাভাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে পাচার করতেন তারা। আনারের বিরুদ্ধে হত্যা অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে অন্তত দেড় ডজনের বেশি মামলা ছিল।

ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার তাকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটায়। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশন ক্লিন হার্ট’ শুরু হলে আত্মগোপনে ছিলেন আনার।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যোগ দেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। এর আগে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল ভারতের মাটিতে হত্যার শিকার আনার। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি ফের ভারতে চলে যান । আবার ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে দেশে ফিরে আসেন আনোয়ারুল আজীম আনার। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনবার আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হওয়া আনোয়ারুল আজীম (আনার) এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় নাম ছিল তার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পান।

মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের কারবারের সঙ্গে কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কমিশনারের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারে জড়ান তিনি। তার অবৈধ অস্ত্রের চালান চরমপন্থি ক্যাডার সামসেল ওরফে রবিনের কাছে বিক্রি হতো।

কথিত আছে, সরকারের পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ ভারতে আত্মগোপন করার পর তার মাধ্যমে অস্ত্র চোরাকারবার চালিয়ে যান আনার। বাগদা এলাকার মাদক সম্রাট জয়ন্ত কুমার, কার্তিক, গৌতম সাহা ও বনগাঁর দেবদাসের সঙ্গে আনারের মাদকের কারবার ছিল।

সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম স্বর্ণ আটক করে তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। চোরাকারবারিরা নিশ্চিত হন যে, দর্শনা শ্যামপুরের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম স্বর্ণগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। ওই ঘটনায় টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন সাইফুল।

তিনি নিজেও স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন। ওই হত্যা মামলায় আনারসহ আসামি করা হয় ২৫ জনকে। কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা মুকুল, শাহীন রুমী, ঝিনাইদহের চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুর, আনারসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ, আনারসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এ মামলায় আনারকে গ্রেপ্তারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। এর দশ দিন পর ওই বছরের ২১ জানুয়ারি তাকে গ্রেপ্তারের জন্য নিশ্চিন্তপুর গ্রামে তার বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশিরভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার।

জানা যায়, এক নারীসহ মোট ছয়জন আনারের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। তাদের সবাই বাংলাদেশি নাগরিক। এমপিকে হত্যার পর পাঁচজন দেশে ফিরে আসে এবং একজন এখনও ভারতেই অবস্থান করছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যবসায়িক বিরোধের জেরে ঝিনাইদহ-৪ সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্যকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। আনার হত্যার মাষ্টার মাইন্ড মার্কিন নাগরিক আখতারুজ্জামান শাহীন।

খুনের পর অনারের দেহ টুকরো টুকরো করে রাখা হয় ফ্রিজে। পরে ভাড়াটে লোক মারফত একটি ট্রলি ব্যাগে ভরে মরদেহের টুকরোগুলো বাহিরে ফেলে দেওয়া হয়। তবে পুলিশ এখনো পর্যন্ত মরদেহের টুকরোগুলো খুঁজে পায়নি। কিলিং স্কোয়াড়ে ছিলেন পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা আমানুল্লাহর নেতৃত্বে জিহাদ সিয়াম, মোস্তাফিজ, ফয়সাল তানভীর। খুনের সময় এই নিউটাউনের ফ্ল্যাটে শিলাস্তি নামে এক নারীও উপস্থিত ছিলেন। তিনি খুন হওয়া সংসদ সদস্যের ব্যবসায়িক অংশীদার আখতারুজ্জামান শাহীনের বান্ধবী। আখতারুজ্জামান নেপাল হয়ে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও শিলাস্তি রহমান, আমানুল্লাহ ও ফয়সাল গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর।

এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে বাংলাদেশে সৈয়দ আমানুল্লাহ, শিলাস্তি রহমান ও ফয়সাল আলী ওরফে সাজি নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। আনারকে হত্যার জন্য ৫ কোটি টাকার চুক্তি হয় মার্কিন নাগরিক আখতারুজ্জামান শাহীনের সাথে।

বিএনএনিউজ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম/এইচমুন্নী

Loading


শিরোনাম বিএনএ