বিএনএ, ডেস্ক: মুমিনের ধর্মীয় জীবনে চারিত্রিক পরিশুদ্ধতার মূল্য অনেক। কেননা ইসলাম চারিত্রিক পরিশুদ্ধতা রক্ষা করার এবং যেসব কারণে চারিত্রিক অধঃপতন ঘটে তা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন প্রকারের লোক—যাদের ওপর আল্লাহর জন্য হক রয়েছে, মহান আল্লাহ অবশ্য তাদের সাহায্য করবেন, মুকাতাব (অর্থের বিনিময়ে মুক্তিপ্রার্থী) দাস যা আদায় করার ইচ্ছা পোষণ করে, যে বিবাহিত ব্যক্তি চারিত্রিক পূতঃপবিত্রতা চায় এবং আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামকারী।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩২১৮)
চারিত্রিক অধঃপতনের ১০ কারণ
কোরআন ও হাদিসের আলোকে চারিত্রিক অধঃপতনের ১০টি কারণ বর্ণনা করা হলো-
১. ঈমানের দুর্বলতা: চারিত্রিক অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ ঈমানের দুর্বলতা। দৃঢ় ঈমানের অধিকারী ব্যক্তি কখনো পাপ ও অন্যায়ে লিপ্ত হতে পারে না। এ জন্য মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘জিনাকারী জিনা করার সময় (পরিপূর্ণ) মুমিন থাকে না, চোর চুরি করার সময় মুমিন থাকে না, মদপানকারী মদ পান করার সময় মুমিন থাকে না। তবে তার পরও তাওবা উন্মুক্ত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৮১০)
২. ধর্মীয় জ্ঞান না থাকা: ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবেও ব্যক্তির চারিত্রিক অধঃপতন ঘটে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘চার প্রকারের মানুষের জন্য দুনিয়া : …আরেক প্রকার বান্দা, আল্লাহ তাআলা তাকে ধন-সম্পদ প্রদান করেছেন, কিন্তু ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) দান করেননি। আর সে ইলমহীন হওয়ার কারণে তার সম্পদ স্বীয় প্রবৃত্তির চাহিদামতো ব্যয় করে। সে ব্যক্তি এ বিষয়ে তার রবকেও ভয় করে না এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সৌজন্যমূলক ব্যবহারও করে না। আর এতে যে আল্লাহ তাআলার হক আছে তা-ও সে জানে না। এই লোক সর্বাধিক নিকৃষ্ট স্তরের লোক।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩২৫)
৩. অন্যায়ের প্রতিবাদ না থাকা: সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ না থাকলে পুরো সমাজের চারিত্রিক অধঃপতন হয়। মুমিনের দায়িত্ব হলো সামাজিক পাপ ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি এদেরকে (মুমিনদের) পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে, সৎ কাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎ কাজ নিষেধ করবে; আর সব কাজের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধিকারে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪১)
৪. প্রবৃত্তির অনুসরণ: প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষের মনুষ্যত্ব ধ্বংস করে এবং তাকে পশুত্বের দিকে নিয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি দেখ না তাকে, যে তার কামনা-বাসনাকে ইলাহরূপে গ্রহণ করে? তবু কি তুমি তার কর্মবিধায়ক হবে? তুমি কি মনে করো যে তাদের অধিকাংশ শোনে ও বুঝে? তারা তো পশুর মতোই; বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট!’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪৩-৪৪)
৫. শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ: শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণের কারণে মানুষের চারিত্রিক সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো কেবল তোমাদেরকে মন্দ ও অশ্লীল কাজের এবং আল্লাহ সম্পর্কে তোমরা জানো না এমন সব বিষয় বলার নির্দেশ দেয়।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৬৮-১৬৯)
৬. ভয়ের ওপর আশা প্রবল হলে: মানুষের অন্তর থেকে আল্লাহর ভয় দূর হয়ে যায় এবং ক্ষমা লাভের অযৌক্তিক আশা প্রবল হয়ে ওঠে—তখন সে মন্দ কাজ করতে দ্বিধা করে না। আল্লাহ এই শ্রেণির মানুষকে সতর্ক করে বলেন, ‘তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হলো, তখন আমি তাদের জন্য সব কিছু উন্মুক্ত করে দিলাম; অবশেষে তাদেরকে যা দেওয়া হলো যখন তারা তাতে উল্লসিত হলো তখন অকস্মাৎ তাদের ধরলাম। ফলে তখনই তারা নিরাশ হলো।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৪৪)
৭. লজ্জাহীনতা: নির্লজ্জতা মানুষের চারিত্রিক অধঃপতনের কারণ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন তোমার লজ্জা নেই তখন যা ইচ্ছা করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৪৮৪)
৮. বিলাসিতা: বিলাসিতা চারিত্রিক অধঃপতনের কারণ। আল্লাহ বলেন, ‘আমি যখন কোনো জনপদ ধ্বংস করতে চাই তখন তার সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তিদের সত্কর্ম করতে আদেশ করি, কিন্তু তারা সেখানে অসত্কর্ম করে; অতঃপর তার প্রতি দণ্ডাজ্ঞা ন্যায়সংগত হয়ে যায় এবং আমি তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১৬)
৯. অসৎ সঙ্গ: অসৎ মানুষের সঙ্গ চারিত্রিক অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির অনুসারী হয়। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকে যেন খেয়াল রাখে সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৮৩৩)
১০. বিবাহবিমুখতা: বিয়ে থেকে বিমুখতা এবং বিলম্বে বিয়ে চারিত্রিক অধঃপতনের একটি কারণ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিয়ে করে। কেননা বিয়ে তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থান হেফাজত করে এবং যার বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোজা রাখে। কেননা রোজা তার যৌনতাকে দমন করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০৬৬)
এ ছাড়া আধুনিক যুগের লাগামহীন ব্যক্তিস্বাধীনতা, প্রচারমাধ্যমে অশ্লীলতার সয়লাব, অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবহার, পারিবারিক অনুশাসনের অনুপস্থিতি, অমুসলিম জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে অবাধ মেলামেশা, বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন এবং শিক্ষামাধ্যমে নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি বা নামমাত্র উপস্থিতিও চারিত্রিক অধঃপতনের সহায়ক কারণ।
সচ্চরিত্র রক্ষায় মুমিনের করণীয়
চারিত্রিক অধঃপতন রোধে মুমিনের করণীয় হলো—
১. সর্বাত্মক চেষ্টা করা: চারিত্রিক পরিশুদ্ধতা রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করা মুমিনের দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (পাপ ও ভিক্ষা থেকে) পবিত্র থাকতে চায়, আল্লাহ তাঁকে পবিত্র রাখেন এবং যে পরমুখাপেক্ষিতা থেকে বেঁচে থাকতে চায় আল্লাহ তাকে স্বাবলম্বী করে দেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪২৭)
২. আল্লাহর সাহায্য চাওয়া: উত্তম চরিত্র মুমিনের জীবনে পরম প্রার্থিত বিষয়। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তোমার কাছে আমি সুপথ, আল্লাহভীতি, চারিত্রিক নির্মলতা ও আত্মনির্ভরশীলতা প্রার্থনা করি।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৮৯)
আল্লাহ সবাইকে নৈতিক জীবনযাপনের তাওফিক দিন। আমিন।
বিএনএনিউজ/ বিএম