বিএনএ, ঢাকা : সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের শরীফার গল্প নিয়ে বেশ আলোচনা বইয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ‘শরীফ থেকে শরীফা’ নামক ওই গল্পের পাতা ছিঁড়ে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব। এ ঘটনার পর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরি হারান তিনি।
চাকরি হারার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তার পক্ষে অনেকে সরব হন। মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) সচিবালয়ে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে প্রশ্ন করেন গণমাধ্যমকর্মীরা।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পাঠ্যবইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক পাঠ অংশের উপস্থাপনায় কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকলে এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করলে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
পাশাপাশি মন্ত্রী এটাও স্মরণ করিয়েছেন, দেশে একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে নানা বিষয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে বা ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে নানা সময়ে অরাজকতা করার বা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার প্রবণতা আছে।
কি আছে শরীফার গল্পে :
শরীফার গল্পটি আছে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ শিরোনাম অধ্যায়ে। সেখানে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সচেতনতামূলক আলোচনা করা হয়েছে।
শুরুটা হয়েছে এভাবে : খুশি আপা (শিক্ষক) ক্লাসে একজন অতিথিকে নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ইনি ছোটবেলায় তোমাদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আজ এসেছেন নিজের স্কুলটা দেখতে।
সুমন (শিক্ষার্থী) জানতে চাইল, আপনার নাম কী? তিনি বললেন, আমার নাম শরীফা আকতার। এরপর শরীফা তাঁর জীবনকাহিনি বলতে শুরু করেন। শরীফা বললেন, যখন আমি তোমাদের স্কুলে পড়তাম, তখন আমার নাম ছিল শরীফ আহমেদ। আনুচিং (শিক্ষার্থী) অবাক হয়ে বলল, আপনি ছেলে থেকে মেয়ে হলেন কী করে? শরীফা বললেন, আমি তখনো যা ছিলাম, এখনো তা-ই আছি। নামটা কেবল বদলেছি। ওরা শরীফার কথা যেন ঠিকঠাক বুঝতে পারল না।
আনাই (শিক্ষার্থী) তাঁকে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়? শরীফা বললেন, আমার বাড়ি বেশ কাছে। কিন্তু আমি এখন দূরে থাকি। আনাই মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি, আমার পরিবার যেমন অন্য জায়গা থেকে এখানে এসেছে, আপনার পরিবারও তেমনি এখান থেকে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে। শরীফা বললেন, তা নয়। আমার পরিবার এখানেই আছে। আমি তাদের ছেড়ে দূরে গিয়ে অচেনা মানুষদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছি। এখন সেটাই আমার পরিবার। তাদের অবাক হতে দেখে শরীফা এবার নিজের জীবনের কথা বলতে শুরু করলেন।
ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময় বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। আমি মেয়েদের মতো পোশাক পরতে ভালোবাসতাম। কিন্তু বাড়ির কেউ আমাকে পছন্দের পোশাক কিনে দিতে রাজি হতো না। বোনদের সাজবার জিনিস দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সাজতাম। ধরা পড়লে বকাঝকা, এমনকি মারও জুটত কপালে। মেয়েদের সঙ্গে খেলতেই আমার বেশি ইচ্ছে করত। কিন্তু মেয়েরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তারা আমার কথাবার্তা, চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করত। স্কুলের সবাই, পাড়াপড়শি—এমনকি বাড়ির লোকজনও আমাকে ভীষণ অবহেলা করত। আমি কেন এ রকম, এ কথা ভেবে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হতো, নিজেকে ভীষণ একা লাগত।
একদিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো, যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে; কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই মনে করে। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)। সেই মানুষটা আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যেখানে নারী-পুরুষের বাইরে আরও নানা রকমের মানুষ আছেন। তাঁদের বলা হয় ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী। তাঁদের সবাইকে দেখেশুনে রাখেন তাঁদের ‘গুরু মা’। আমার সেখানে গিয়ে নিজেকে আর একলা লাগল না, মনে হলো না যে আমি সবার চেয়ে আলাদা। সেই মানুষগুলোর কাছেই থেকে গেলাম। এখানকার নিয়মকানুন, ভাষা, রীতিনীতি আমাদের বাড়ির চেয়ে অনেক আলাদা। আমরা সবার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একটা পরিবারের মতনই থাকি। বাড়ির লোকজনের জন্যও খুব মন খারাপ হয়। তাই মাঝে মাঝে বাড়িতেও যাই।
আজ থেকে ২০ বছর আগে বাড়ি ছেড়েছি। সেই থেকে আমি আমার নতুন বাড়ির লোকদের সঙ্গে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে, নতুন শিশু আর নতুন বর-বউকে দোয়া-আশীর্বাদ করে পয়সা রোজগার করি। কখনো কখনো লোকের কাছে চেয়ে টাকা সংগ্রহ করি। আমাদেরও ইচ্ছে করে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা, চাকরি-ব্যবসা করতে। এখনো বেশির ভাগ মানুষ আমাদের সঙ্গে মিশতে চায় না, যোগ্যতা থাকলেও কাজ দিতে চায় না। তবে আজকাল অনেক মানুষ আমাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। ইদানীং আমাদের মতো অনেক মানুষ নিজ বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করছে। আমাদের মতো মানুষ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। অনেক দেশেই তারা সমাজের বাকি মানুষের মতনই জীবন কাটায়। তবে আমাদের দেশের অবস্থারও বদল হচ্ছে। ২০১৩ সালে সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য কাজ করছে। শিক্ষার ব্যবস্থা করছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রচেষ্টা নিচ্ছে। নজরুল ইসলাম ঋতু, শাম্মী রানী চৌধুরী, বিপুল বর্মণের মতো বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ সমাজজীবনে এবং পেশাগত জীবনে সাফল্য পেয়েছেন।
সফলতার উদাহরণ দিতে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে সফল কয়েকজন হিজড়ার ছবি দেওয়া হয়েছে।
বিএনএনিউজ/এইচ.এম/এইচমুন্নী