।। বাবর মুনাফ ।।
বাংলাদেশে ঠিক কখন থেকে গুম খুনের রাজনীতি শুরু হয়, তার সঠিক তথ্য কোথাও নেই। বাংলাদেশে গুমের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগের রাতে বাংলাদেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে রাঙ্গামাটির লালাঘোনায় তার গ্রামের বাড়ি থেকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। এত বছরেও তার খোঁজ মিলেনি।
দেশে সবচেয়ে আলোচিত গুমের ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল। রাত দেড়টায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরের বনানী ২ নম্বর সড়কের সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে থেকে অপহৃত হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালক আনসার আলী।

অভিযোগ আছে, ভারতের মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখ বাঁধ আন্দোলনের কারণে শেখ হাসিনার নির্দেশে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। গত ১২ বছরেও তার খোঁজ মিলেনি। ইলিয়াস আলীর অপহরণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তৎকালীন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল আহসান।
পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে তিনি মেজর জেনারেল হন। সর্বশেষ তাকে জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার -এনটিএমসির মহাপরিচালক করা হয়। এনটিএমসিতে যোগদানের আগে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক ছিলেন। ৫ আগষ্ট পরবর্তী সময়ে তাকে চাকুরিচ্যুত ও গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন, আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুমের সঙ্গে ভারতীয় কিছু ব্যক্তির সম্পৃক্ততা পেয়েছে। গত ১৪ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে যে প্রতিবেদন দিয়েছে কমিশন, সেখানে একাংশে বলা হয়েছে, ‘নিখোঁজ ব্যক্তিদের মাথায় গুলি করে, লাশ, সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। মরদেহ ট্রেনের নিচে ফেলা, তুলে নেওয়া ব্যক্তিকে গাড়িতে চাপা দেওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে।’
গুম কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশন ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরের এক হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে। এদের মধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করেছে ৭৫৮টি অভিযোগ।
অভিযোগের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে এবং ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ২১টি অভিযোগ জমা পড়েছে।
সাধারণত র্যাব ও ডিজিএফআই-এর বিভিন্ন স্থাপনায় এসব নির্যাতনের সব বন্দোবস্ত ছিল বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর পরিচালিত বন্দিশালাগুলোয় নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো, যার মধ্যে ছিল সাউন্ডপ্রুফ কক্ষ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য ডিজাইন করা বিভিন্ন যন্ত্র।
কমিশন দুটি নির্যাতনের উদাহরণ দিয়েছে। ২০১০ সালে ঢাকার ধানমন্ডি থেকে র্যাবের এক যুবককে অপহরণ করে কোন অ্যানেসথেসিয়া ছাড়া ঠোঁট সেলাই করে দেয়।
আরেক ভুক্তভোগীর ওপর নানা শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়, বিশেষ করে তার কানে ও যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। গুমের শিকারদের বেশিরভাগ সময়—হয় মেরে ফেলা হতো, না হলে অপরাধী হিসাবে বিচার ব্যবস্থায় সোপর্দ করা হতো।
গুমের শিকার বেশিরভাগই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ভিন্নমতের মানুষকে তুলে নিয়ে অজ্ঞাতস্থানে আটক করে রাখা হয়। যা আয়না ঘর নামে পরিচিত। দীর্ঘদিন অজ্ঞাত স্থানে রাখার পর যারা ফিরে এসেছিলেন, তারাও ‘টু’ শব্দটি করেননি; মুখে ছিপি এঁটে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বদলে যায় প্রেক্ষাপট। গুমের পর ‘আয়না ঘর’ থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা তাদের নৃশংস নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন।
কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গুম শুধু বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ। সুখরঞ্জন বালি ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে গুমের পর ভারতে স্থানান্তরের ঘটনা উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে। সুখরঞ্জন বালিকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে অপহরণের পর ভারতীয় কারাগারে পাওয়া যায়।
যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের, কমিশনকে জানিয়েছেন, তাঁকে যে গোপন বন্দিশালায় রাখা হয়েছিল, সেই সেলের বাইরে কাউকে হিন্দিতে কথা বলতে শুনেছেন। তাকে ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট ঢাকা চীফ মেট্টোপলিটন আদালত এলাকা থেকে অপরহরণ করে ডিবি পুলিশ। এরপর ২০১৭ সালের ২ মার্চ ভোরে ধানমন্ডির বাড়ির সামনে চোখ বেঁধে তাকে ফেলে যায়। হুম্মাম বলেছেন, তার পরিবার আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে দফারফা করার পর তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, র্যাবের গোয়েন্দা শাখার যারা অভিযানে সক্রিয় ছিল তারা জানিয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বন্দিবিনিময় করত। বাংলাদেশের গুমের ঘটনা যে আন্তর্জাতিক ও সুসংগঠিত চক্রের অংশ—এসব ঘটনা তারই বহিঃপ্রকাশ।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে ২০১৫ সালে রাজধানীর উত্তরা থেকে তুলে নেওয়ার পর ভারতে পাওয়া—এর উদাহরণ। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে, তাঁকে যে নির্জন স্থানে রাখা হয়েছিল সেখানে টাস্কফোর্স অব ইন্টারোগেশন লেখা কম্বল ছিল, সেই সময়ে র্যাব সদর দপ্তরের তত্ত্বাবধানে টিএফআই পরিচালিত হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তদন্ত কমিশন পরিদর্শনে নিশ্চিত হয়েছে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা এখন টিএফআইয়ে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। তবে বন্দিশালার ভেতরের অবকাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে কিছুদিন আগে। সালাহউদ্দিন আহমেদ কমিশনকে জানিয়েছেন, তাঁকে ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছিল। যে সন্দেহভাজন বাংলাদেশি কর্মকর্তা সেখানে ছিলেন, তিনি পরিচয় লুকাতে ‘যম টুপি’ পরা ছিলেন, যা দুই দেশের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এবং নিরাপত্তা বাহিনীর যোগাযোগকে নির্দেশ করে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একজন সৈনিক তদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন, ‘বন্দি বিনিময়ের’ সময়ে ২০১১ সালে দুই দফা তিনি তামাবিল সীমান্তে ছিলেন। দুই দফায় তিনজন ‘বন্দিকে’ আনা হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাদা পোশাকধারী সদস্যরা সেখানে ছিলেন। দু’জন ‘বন্দিকে’ রাস্তার পাশে হত্যা করা হয়। জীবিত আরেক বন্দিকে র্যাবের আরেকটি দলের কাছে তুলে দেওয়া হয়। র্যাবও দু’জন ‘বন্দিকে’ একই প্রক্রিয়ায় ভারতীয়দের কাছে তুলে দিয়েছিল।
বিএনএনিউজ/ সাকিব