বিএনএ, ডেস্ক :জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমান। যিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুর ‘সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম’ থেকে ১২ লাখ টাকায় কথিত উচ্চ বংশীয় ছাগল কিনে ভাইরাল হওয়া ১৯ বছর বয়সী তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাতের বাবা। যদিও এই ছাগলকান্ডের পর তিনি অতি সূনিপুণভাবে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভের সন্তানকে অস্বীকার করেছেন। মতিউরের দাবি, তিনি এক টাকাও দূর্নীতির মাধ্যমে আয় করেনি। যদিও ছাগল কান্ডের পর তার একের পর এক দুর্নীতি, অনিয়ম ও কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারসহ বহু ঘটনা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। খুলছে প্যান্ডোরার বাক্স।
মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে জমা পড়া অভিযোগটি যাচাই করে কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যেই দুদকের কর্মকর্তারা মাঠে নেমেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগের আমলে দোর্দন্ড প্রতাপে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ড. মতিউর রহমান কাস্টমস বিভাগে দুর্নীতির রাজা হয়ে উঠেছেন! বিএনপি ও বর্তমান সরকারের আমলে মতিউর রহমান কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। এনবিআরের কোন কর্মকর্তার নির্দেশনা তিনি মানতেন না। সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান তার আত্মজীবনীতে ড. মতিউর রহমান সম্পর্কে বিভিন্ন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৪ সালে বাণিজ্য ক্যাডার (১১তম ব্যাচ) হিসেবে ড. মতিউর রহমান সহ সাত জন এক সাথে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। একই সঙ্গে কাস্টমস ক্যাডারে যোগদান করেন ১৯ জন ক্যাডার। ওই সাত জন হলো বহিরাগত ক্যাডার। যেহেতু কাস্টমস ক্যাডারে ছিল না এই সাত জন, এ কারণে তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন তাদেরকে ফেরত পাঠানোর জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
সুচতুর মতিউর সুপ্রিম কোর্টের আদেশ আইনে আত্মীকরণ হয়ে যান। এরপর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত হন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে। অর্থমন্ত্রীর ছেলেদের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করেন মতিউর। হয়ে ওঠেন ক্ষমতাধর কর্মকর্তা। অর্থমন্ত্রীর রুমে বিনা বাঁধায় প্রবেশ করতেন মতিউর।
তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কবরে গিয়েও মতিউর রহমান কান্নাকাটি করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ফলে এনবিআরের চেয়ারম্যানকে তোয়াক্কা করতেন না মতিউর।
ওয়ান ইলেভেনের সময় এনবিআরের চেয়ারম্যান ছিলেন বদিউর রহমান। তিনি মতিউর রহমানকে বদলি করেন রাজশাহীতে। ওই সময় এনবিআরের চার জন সদস্য মতিউরকে বদলি না করতে চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেন। কিন্তু বদিউর রহমান তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। এ অবস্থায় একের পর এক শীর্ষ পর্যায় থেকে তদবির আসা শুরু হলো। অন্য সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তার বদলি স্থগিত রাখার চেষ্টা করেন। বদলি ঠেকাতে দুই জন ক্ষমতাধর সচিবও কাজ করেছেন। যারা বিগত দিনে তার কাছ থেকে আর্থিকভাবে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দিন আহমেদ পর্যন্ত সুপারিশ করেন। তখন সরকার প্রধানের সুপারিশ অনুযায়ী বদিউর রহমান তার বদলির আদেশ স্থগিত রাখেন। সৎ নিষ্ঠাবান অফিসার হিসেবে পরিচিত এই বদিউর রহমান ১৫ মাস পর স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন। বদিউর রহমান তার আত্মজীবনীতে এই সব বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মতিউর রহমান একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ। ওয়ান ইলেভেনের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারাও মতিউরের বদলি ঠেকানোর জন্য তদবির করেন।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একই কাজ করেছেন মতিউর। আওয়ামী লীগের একজন ক্ষমতাধর নেতার এপিএস হন। ফলে তার অবৈধ আয় চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেন।
বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি বিষয়ক কাজ করতেন। কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট থাকায় বহু মামলা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিস্পত্তি করে দিতেন। বিমান বন্দর থেকে স্বর্ণ চোরাচালানের সাথেও জড়িত মতিউর। ঢাকা এয়ারপোর্ট, যশোর এয়ারপোর্ট, বেনাপোল স্থলবন্দর ও চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে দায়িত্ব পালন করেছেন। অবৈধভাবে আয় করা শত শত কোটি টাকা আয় করে বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে মতিউরের বিরুদ্ধে। এনবিআরের বর্তমান চেয়ারম্যান একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। বর্তমান চেয়ারম্যানকে বশ করতে পারেনি মতিউর। কিন্তু বর্তমান দুই জন ক্ষমতাধর সচিবের কারণে, চেয়ারম্যান মতিউরের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।
মতিউর রহমানের নরসিংদী, ময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়াও গাজীপুরের পূবাইলে রিসোর্ট, শুটিংস্পট, বাংলো বাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পদ। বরিশালেও রয়েছে তার বিপুল সম্পদ।
শুধু দেশে নয় বিদেশেও বাড়ি রয়েছে মতিউরের। তার ছেলের রয়েছে বিশ্বের নামিদামী ব্র্যান্ডের গাড়ির কালেকশন। তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার নামে পুঁজিবাজার এবং এর বাহিরের প্রায় ডজনখানেক কোম্পানির অংশীদারীত্বের নথিপত্র দুদকের কাছে এসেছে।
এসব নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গাজীপুরের গ্লোবাল সু ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং কোম্পানিতে তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার মালিকানা রয়েছে। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে কৌশলে প্লেসমেন্ট শেয়ার নেন মতিউর রহমান। আর গ্লোবাল ম্যাক্সের মালিকানা রয়েছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি এসকে ট্রিমস ইন্ডাস্ট্রিজে। ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান শাহজালাল ইক্যুইটিতেও মালিকানা রয়েছে তার। শুধু ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নয়, অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন নামে পুঁজিবাজারের আরেক কোম্পানিতে ২৭ লাখ ৪৫ হাজার ৫ শত শেয়ার রয়েছে। বর্তমান শেয়ার বাজারের দর নিয়ন্ত্রণের বড় হোতা হিসাবেও মতিউরের নাম প্রকাশ পেয়েছে।
মতিউর তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজকে আর্থিক দাপটের মাধ্যমে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী ব্যাংক কর্মকর্তা। তাদের নামেও রয়েছে সম্পদের পাহাড়।
মতিউর রহমান বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থাকেন। তার পারিবারিক মালিকানাধীন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের হেড অফিসও ওই এলাকায়। এ ছাড়া মতিউর রহমানের ছেলে অর্ণবের নামে অর্ণব ট্রেডিং নামেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার মেয়ের ল্যাম্বারগিনি নামে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যার দাম প্রায় ৪ লাখ কানাডিয়ান ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমান নিজেই এখন আরব্য রজনীর আলাদীনের চেরাগ।
শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ওজি/হাসনা