।। ইমাদ উদ দীন।।
বিএনএ,মৌলভীবাজার: চিরচেনা চায়ের রাজ্যের সবুজ দুনিয়া এখন অনেকটাই বিবর্ণ। কারণ দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে চায়ের কাঙ্খিত সেই নতুন সবুজ কুঁড়ির দেখা নেই। তাই দু’টিপাতা একটি কুঁড়ি সংগ্রহের ব্যস্ততাও নেই চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানে।
অল্প ক’টি চা বাগানে নিজস্ব যান্ত্রিক সেচ ব্যবস্থা থাকলেও অধিক খরচে কৃত্রিম ওই সেচেও মিলছে না প্রত্যাশিত চায়ের নতুন কুঁড়ি। কয়েকটি চা বাগানে নতুন মৌসুমের চা পাতা চয়ন শুরু হলেও তা প্রতিদিন ফ্যাক্টরি সচল রাখার মত পর্যাপ্ত নয়। ওই বাগানগুলোতে একজন শ্রমিক প্রতিদিন চা পাতা সংগ্রহ করছেন ৬-৭ কেজি। যেখানে প্রতিদিন সংগ্রহ হওয়ার কথা ৮০-৯০ কেজি। গেল বছর শ্রমিক আন্দোলনে চা শিল্পের ক্ষতি পুষিয়ে এবছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রত্যাশা মালিক শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে এবছর মৌসুমের শুরুতেই চা পাতা চয়ন অনেকটাই পিছিয়ে।
চলতি মাসে দু’একদিন কিছু বৃষ্টি হলেও তা পরিমাণে ছিল কম। তারপরও ওই উপকারি বৃষ্টির সুফলতা দৃশ্যমান হতে সপ্তাহদিন লাগবে। তবে এবছর মৌসুমের শুরুতেই দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
শ্রমিকরা জানান, মৌসুমের শুরুতে পাতা কম আসায় তারা কষ্টে আছেন। ২৩ কেজিতে নিরিখ হলেও তারা ৫-৬ কেজিতে দৈনিক মজুরি পেলেও বাড়তি পাতা সংগ্রহের মজুরি থেকে হচ্ছেন বঞ্চিত। এখনো জমে উঠেনি প্রত্যাশিত চা পাতা উত্তোলন। তাই জমে উঠছে না চিরচেনা পাতিচানা বা পাতিচোখা। গণতিঘর ও তলবের হাটও।
জানা যায়, পাতিচানা বা পাতিচোখা হল চা পাতার সাথে অন্যান্য উপকরণ দিয়ে তৈরি বিশেষ একধরনের ভর্তা যা শ্রমিকরা কাজের মাঠে রুটি দিয়ে দুপুরের খাবার সারেন দলবদ্ধ হয়ে একস্থানে বৈঠকি ঢংয়ে বসে। ওই সময় সুখ দুখের গল্প আড্ডায় তারা মেতে উঠেন। গণতিঘর হল শ্রমিকরা কাজে যোগদানের শুরুতে জমায়েত হওয়ার ঘর যেখানে শ্রমিক গণনা করে বিভিন্ন সেকশনে কাজে পাঠানো হয়। আর তলবের হাট হলো বাগানের নির্দিষ্ট মাঠে একদিনের অস্থায়ী হাট। যেখানে সপ্তাহে একদিন শ্রমিকরা মজুরির টাকা একসাথে পেলে ওখান থেকেই তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করেন। এখন চাপাতা পর্যাপ্ত না থাকায় অনেকটাই অচল ওই চিরচেনা দৃশ্যের।
চা শ্রমিকরা জানান, পাতিচানা বা পাতিচোখা, গণতিঘর ও তলবের হাট,পাগলা ঘণ্টা (বিপদ সংকেতের সর্তকবার্তা) আর চা বাগানের চার দেওয়ালের ভেতরের নানা কঠোর রীতিনীতি। যুগ যুগ ধরেই এটিই তাদের চিরচেনা সাম্রাজ্য। চা বাগানের অলিখিত সাম্রাজ্যের নানা শৃঙ্খলে তারা আবদ্ধ।
চায়ের সবুজ দুনিয়ার আড়ালে চা শ্রমিকদের জীবন সংগ্রামের গল্প ঢাকা পড়েছে। কেউ জানেনা কিংবা জানতেও চান না ওই সবুজ দুনিয়া সচল রাখার নেপথ্যের কারিগর কারা। কেমনই বা চলে ওই লোকগুলোর জীবন সংসার। জীর্ণ শীর্ণ পুষ্টিহীনতায় রোগা শোকা চা শ্রমিকদের চরম দুঃখ কষ্টই কেবল তাদের নিত্য জীবন সঙ্গী। তবে গেল বছরের চা শ্রমিকদের আন্দোলনে এদেশের চা শিল্প অচল হলে সচল হয় তাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জীবনের অজানা গল্প। তখনই শিল্প বাচাঁনোর চিন্তায় নেপথ্যের লোকগুলোর খোঁজখবর নিতে থাকেন সংশ্লিষ্টরা। যখন কর্মবিরতি আর ধর্মঘটে স্থবির হয়ে পড়ে সবুজ চায়ের দুনিয়া। এরপর প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস ও হস্তক্ষেপে কাজে সরব হন দেশের ১৬৭ টি চা বাগানের শ্রমিকরা। তবে আন্দোলনের সময় প্রাপ্ত মজুরির এরিয়ার এখনো না পাওয়ায় ভেতরে ভেতরে শ্রমিক অসন্তুষ চলছে। এনিয়ে চা শ্রমিক সংগঠনগুলো নানা বিবৃতি ও হুঁশিয়ারি অব্যাহত রেখেছেন। চা শিল্পের নানা সংকট ও টানপোড়ন দেখিয়ে মালিকপক্ষ তা দিতে গড়িমিশি করছেন।
জানা যায়, ভাল উৎপাদনের জন্য প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্তবয়স্ক চা গাছের উপরের অংশ কেটে দেওয়া হয়। এর পর বৃষ্টিপাত হলে ওই চা গাছে নতুন কুঁড়ি গজাতে থাকে এবং ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই উৎপাদন শুরু হয়। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ায় এ বছর অধিকাংশ চা বাগান এখনো উৎপাদনে আসতে পারেনি।
চা গবেষণা ইন্সটিটিউট সূত্রে জানা যায়, চা উৎপাদনের জন্য প্রতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কমপক্ষে ২শ মিলিমিটার ও জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে ৪৫০ মিলিমিটার বৃষ্টির প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে গেল নভেম্বর থেকে মার্চের ৩য় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় ৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১শ মিলিয়ন কেজি চা। বৈরী আবহাওয়া ও অন্যান্য কারণে ওই বছর চা উৎপাদন হয়েছে ৯৪ মিলিয়ন কেজি। চলতি বছর ২০২৩ সালে আবারও দেশে ১শ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টি এসোসিয়েশন সিলেট ব্রাঞ্চ চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী ও এম আর খান চা বাগান এর জেনারেল ম্যানেজার জহির আহমদ চৌধুরী বলেন, সময়মতো কাঙ্খিত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফ্যাক্টরিগুলোও পুরোপুরি চালু হচ্ছে না। সব সেকশনে চা পাতা উত্তোলনে শ্রমিকদেরও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তারা চা শিল্পের নানা সমস্যা ও সংকটের কথা তোলে ধরে বলেন মৌসুমে অনুকূল আবহাওয়া না পেলে কেবল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র অর্জন নয় বরং এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখাও চ্যালেঞ্জিং হবে।
বিএনএ/এমএফ