বিএনএ, ঢাকা: ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডায় বিনিয়োগকারী বাংলাদেশির সংখ্যা সর্বোচ্চ। সে দেশের বিশেষ নাগরিকত্ব প্রকল্পে বিনিয়োগ করে ইতোমধ্যে পাসপোর্ট নিয়েছেন জামান গ্রুপ অব ইন্ডাষ্ট্রিজের পরিচালক ও ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংক লি. এর ইসি চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি। তিনি চট্টগ্রামের প্রয়াত রাজনীতিবিদ আক্তারুজ্জামান চৌধুরীর ছেলে এবং সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ছোটভাই।
অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডার নাগরিক চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির পাসপোর্ট নম্বর এবি০৮৬৮৭১ ।
আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি একা নন, অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডার নাগরিকত্ব নিয়েছেন তার স্ত্রী ইমরানা জামান চৌধুরীও। তিনি মেঘনা ব্যাংক লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ও নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া লাইট হাউজ নেভিগেশন লিমিটেড এবং মেন্টিকোর টেকনোলজি লিমিটেডেরও পরিচালক ইমরানা জামান চৌধুরী। তার পাসপোর্ট নম্বর এবি০৮৬৮৭২।
অ্যান্টিগুয়ান অ্যান্ড বারবুডান নাগরিক হিসাবে ২০১৮ সালের ৮ মার্চ তাদের নামে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। পাসপোর্টগুলোয় ২০৩২ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশ ভ্রমণের সুবিধা রয়েছে।
আনিসুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রীর পক্ষ থেকে সম্প্রতি ঢাকার পাসপোর্ট অধিদপ্তরে ‘নো ভিসা’র আবেদন করা হয়। কিন্তু তাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে এ সংক্রান্ত আবেদনে গোয়েন্দা ছাড়পত্র চাওয়া হয়।
এজন্য জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)কে চিঠি দেয় পাসপোর্ট অধিদপ্তর।
২০২৩ সালের ২ আগস্ট বিএফআইইউ-এর যুগ্মপরিচালক তরুণ তপন ত্রিপুরা স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের বাহিরে বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য অর্থ প্রেরণের প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনের আবশ্যকতা রয়েছে।
এক্ষেত্রে উল্লিখিত ব্যক্তিদ্বয় কর্তৃক অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডায় বিনিয়োগের অনুমতির তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাওয়া যায়নি। এ ধরনের অনুমোদন ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ করলে তা মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসাবে বিবেচ্য।’
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, দ্বীপরাষ্ট্র গ্রেনাডার নাগরিকত্ব নিয়েছেন চট্টগ্রামের বৃহৎ শিল্পপরিবার টিকে গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তফা হায়দার ও তার স্ত্রী ফাতেমা সালমা কামাল। গ্রেনাডিয়ান হিসাবে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একই সময় পাসপোর্ট হাতে পান তারা। সেন্ট জর্জেস থেকে ২০২৩ সালের ৪ মে তাদের পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। ২০২৮ সালের ৪ মে পর্যন্ত তাদের পাসপোর্টের মেয়াদ রয়েছে।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ‘নো ভিসা’ আবেদনে তারা গ্রেনাডার দুটি পাসপোর্টের কপি সংযুক্ত করেন। এতে মোস্তফা হায়দারের পাসপোর্ট নম্বর জিএ০৮৫০৯১ এবং স্ত্রী ফাতেমা সালমা কামালের পাসপোর্ট নম্বর জিএ০৮৫০৯০। দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আবেদনের সঙ্গে নিজেদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও জমা দেন তারা।
পাসপোর্ট অধিদপ্তর বলছে, শুধু জামান গ্রুপের আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি কিংবা টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তাফা হায়দার নয়- কতিপয় অখ্যাত দ্বীপরাষ্ট্রের পাসপোর্ট দেখিয়ে অনেকেই ‘নো ভিসা’র আবেদন করছেন। এমনকি তাদের আবেদন দ্রুত অনুমোদনের জন্য তদবির আসছে প্রভাবশালীদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্যারিবীয় কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রের পাসপোর্টে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বহুদেশে ভিসামুক্ত চলাচলের সুবিধা রয়েছে। এ কারণে কোটি টাকা বিনিয়োগে এসব দেশের পাসপোর্ট নিচ্ছেন অনেকে। এর মধ্যে গড়ে এককালীন দেড় থেকে দুই লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগে নাগরিকত্বসহ পাসপোর্ট দেয় অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, ডমিনিকা, গ্রেনাডা, মাল্টা, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেন্ট লুসিয়া ও ভানুয়াতুর মতো কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র। এমনকি কয়েকটি দেশ সরাসরি তাদের জাতীয় উন্নয়ন তহবিলে অর্থ জমা নেয়। আবার কয়েকটির আবাসন প্রকল্পে বিনিয়োগ করার ৩ থেকে ৫ মাসের মধ্যেই নাগরিকত্ব মেলে।
ইতোমধ্যে অনেকের হাতে হাতে ঘুরছে ক্যারিবীয় কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রের এসব পাসপোর্ট। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রাজনীতিবিদ ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছাড়াও আছেন সরকারি-বেসরকারি সেক্টরের প্রভাবশালীরা। পরিচয় লুকিয়ে ভিন্ন নাম-ঠিকানায় পাসপোর্ট পেতেও মরিয়া অনেকে। বাংলাদেশি কোটিপতিদের অনেকেই ইউরোপ বা আমেরিকাকে বাদ দিয়ে এখন অখ্যাত কয়েকটি ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্রের পাসপোর্ট প্রকল্পে দুহাতে টাকা ঢালছেন। এটি শুধুই কী নিছক নাগরিকত্ব নেওয়া, নাকি আড়ালে টাকা পাচার করার কৌশল তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ২০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে তিনি গড়ে তুলেছেন রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য। ১৮ ফেব্রুয়ারি ব্লুমবার্গ নিউজের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
ব্লুমবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে সাইফুজ্জামানের অন্তত ৫টি প্রপার্টি খুঁজে পেয়েছে। মিউনিসিপ্যাল প্রপার্টির নথি অনুসারে, এসব সম্পত্তি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ছয় মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসে আবাসন—যেখানে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসস্থল এবং লিভারপুলে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ভবন।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রায় আড়াইশ প্রপার্টির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, যখন এই প্রপার্টিগুলো কেনা হয়, তখন যুক্তরাজ্যজুড়ে তীব্র আবাসন সংকট চলছিল এবং এর ৯০ ভাগই ছিল সদ্য তৈরি নতুন বাড়ি। এই বিশাল অঙ্কের সম্পদ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রীর নামে জমা দেওয়া হলফ নামায় সংযুক্ত করা হয়নি। যদিও দেশে বিদেশে সম্পদ থাকলে তা উল্লেখ করার বাধ্যবাদকতা রয়েছে নির্বাচনী আইনে।
বিএনএ/শামীমা চৌধুরী শাম্মী, ওজি/এইচমুন্নী