।।আর করিম চৌধুরী।।
বিএনএ: বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ভয়াল ও নারকীয় সন্ত্রাসী হামলার দিন হচ্ছে ২১ আগস্ট। ২০০৪ সালের এই দিনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে নজির বিহীন গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে হিংসার দানবীয় সন্ত্রাস আক্রান্ত করে মানবতাকে।
গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা। কিন্তু সেদিন নিহত হন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী এবং আওয়ামী লীগের সেই সময়ের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ দলের ২৪ জন নেতা-কর্মী। হামলায় আওয়ামী লীগের চার শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। সেদিন রাজধানীর প্রতিটি হাসপাতালে আহতদের তিল ধারণের জায়গা ছিল না।
সেদিনের সেই গ্রেনেডের স্পিন্টারের মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন এখনও অনেক নেতাকর্মী। অনেক নেতাকর্মীকে তাৎক্ষণিক দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করানো হলেও তারা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন কিংবা আর স্বাভাবিক জীবন ফিরতে পারেননি।
হীম শীতল মৃত্যুর স্পর্শ থেকে বেঁচে যাওয়া অনেকে বিশ্বাসই করতে পারেননি আসলে তারা জীবিত আছেন কি-না। মৃত্যুর এতো কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে আসায় হয়তো তারা নতুন জীবন পেয়েছেন। কিন্তু যতদিন বেঁচে থাকবেন ততোদিন তাদেরকে সেই দুঃস্বপ্নের মত তাড়িয়ে বেড়ানো স্মৃতিকে বহন করে যেতে হবে।
সন্ত্রাস বিরোধী শান্তি সমাবেশের আগে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে স্থাপিত অস্থায়ী ট্রাকমঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার পরপরই তাকে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণের বীভৎসতায় মুহূর্তেই মানুষের রক্ত-মাংসের স্তুপে পরিণত হয় সমাবেশ স্থল। এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। স্পিন্টারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে মানুষের হাত-পাসহ বিভিন্ন অংশ। সভামঞ্চ ট্রাকের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় রক্তাক্ত নিথর দেহ। মরদেহ আর রক্তে ভেসে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সামনের পিচঢালা পথ। নিহত-আহতদের জুতা-স্যান্ডেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ভেসে আসে শত মানুষের গগন বিদারী আর্তচিৎকার। বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টারত মুমূর্ষুদের কাতর-আর্তনাদসহ অবর্ণনীয় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজে বাঁচতে ও অন্যদের বাঁচাতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই বেধড়ক লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল ছোঁড়ে পুলিশ ।
ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা। ভাগ্যগুণে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। সেদিন গ্রেনেড হামলার পাশাপাশি শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করে ১২ রাউন্ড গুলি করা হয়। তবে টার্গেট করা গুলি ভেদ করতে পারেনি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ। হামলার পরপরই শেখ হাসিনাকে কর্ডন করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তার তৎকালীন বাসভবন ধানমন্ডির সুধা সদনে। শেখ হাসিনাকে হত্যার যে কয়টি চেষ্টা করা হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৭ বছর আগের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা।
গ্রেনেড হামলার পর পুরো দেশকে ভয়, শঙ্কা ও ত্রাস গ্রাস করে ফেলে। এই গণহত্যার উত্তেজনা ও শোক আছড়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। সেইসঙ্গে নষ্ট করা হয় সেই রোমহর্ষক ঘটনার যাবতীয় আলামত। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ মদদে ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।
পরবর্তী সময়ে গ্রেনেড হামলার বিচারের রায়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি জোট সরকারের মন্ত্রী ও সরকারের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই হামলাটি পরিচালিত হয়েছিল।
নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১৮ সালের অক্টোবরে বহুল আলোচিত এ মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডেরর রায় দেয় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। তারেক রহমানসহ আরও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১১ জনকে দেয়া হয় স্বল্প মেয়াদে জেল। তবে, রায়ের ৩ বছর পরও হাইকোর্টে এখনও আপিল শুনানি হয়নি। এ মামলায় তারেক রহমানসহ ১৬ আসামি বিদেশে পলাতক আছেন। এছাড়া, অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে মুফতি হান্নানসহ বাকি ৩ জনের।
বিএনএনিউজ