বিএনএ, ঢাকা : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন। সমাবেশে তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হন শেখ হাসিনা। সেদিনের নৃশংস হামলায় মারা যান ২৪ জন। আহত হন অসংখ্য।
সেদিনের ঘটনায় আহত অনেকে এখনও বেঁচে আছে মানসিক ও শারিরীক দু:সহ যন্ত্রণা নিয়ে। পরিবারের প্রিয় জন হারিয়ে হয়েছেন অনেকে এতিম। দিনটি তাদের জন্য এক দু:সহ স্মৃতি।
নাজমুল হাসান পাপন
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। একুশে আগস্টে গ্রেনেড হামলায় মা আইভি রহমানকে হারান তিনি। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ছিলেন আইভি রহমান।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করতেই নাজমুল হাসান পাপন বলেন, আমার সামনে তখন লাশের স্তুপ, আম্মার কাছে যেতে হলে সেই লাশ ডিঙিয়ে যেতে হবে, উপায় নাই যাওয়ার কোন। আমি তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, “আম্মা তুমি চিন্তা কইরো না, আমি চলে আসছি।” জানি না কেন যেন আম্মা মাথাটা নাড়লেন তখন, বুঝলাম যে উনি বেঁচে আছেন। ওখানে যারা ছিল, তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম যে এখন কি করতে হবে৷ ওরা একটা লিস্ট দিয়ে বললেন, এক্ষুণি এই এই ওষুধগুলা লাগবে৷ আমি বললাম যে, ঠিক আছে, আপনাদের এখানেই তো ফার্মেসি আছে, তাই না? ওরা বললো যে না, হাসপাতালের ফার্মেসি বন্ধ। এটা আজকে আর খুলবে না৷ আশেপাশে অনেক ওষুধের দোকান, শত শত। সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, কোন ওষুধ পাবে না কেউ!”
“একুশ তারিখে গ্রেনেড হামলাটা হয়, তেইশ তারিখ রাত বারোটায় আমি সিএমএইচ থেকে বাসায় আসি। পরদিন থেকে আটচল্লিশ বা বাহাত্তর ঘন্টার হরতাল, আওয়ামী লীগ ডেকেছিল। ঠিক রাত দুটোর সময় আমাকে ফোন করা হলো, বললো, খবর পেয়েছেন তো? আমি বললাম কি খবর? বললো, আপনার আম্মা তো মারা গেছেন৷ একটু আগে দেখে গেলাম মানুষটা বেঁচে আছেন, এর মধ্যেই মরে গেলেন! আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি আসছি।”
“ফোনের ওপাশ থেকে বললো, এসে কোন লাভ নাই, আমরা দাফন করে দিচ্ছি। আমি বললাম, দাফন করবেন মানে? আমাদের আত্মীয় স্বজন আছে, আমার আব্বা আছেন, সবাইকে জানাতে হবে, জানাজা পড়াইতে হবে, কবর দেয়া- এগুলো আমরা করব। ওরা বললো যে না, ওপরের নির্দেশ, সব এখানেই করতে হবে! লাশ বাইরে নেয়া যাবে না! কিসের মধ্যে দিয়ে যে গেছি আমি, আজ পর্যন্ত এগুলা কাউকে বলি নাই৷”
আশরাফুল আলম খোকন
সেই সমাবেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলআই’র হয়ে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করছিলেন আশরাফুল আলম খোকন। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার তার শরীরের এখানে ওখানে বিঁধে গুরুতর আহত হন তিনি।
আশরাফুল আলম খোকন বলেন, সেদিন বর্তমান প্রধামন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হতেই হঠাৎ করে মনে হল ট্রাকের যে ডালাটা থাকে, এই ডালার মধ্যে একটা ঢিল পড়ার মত শব্দ হলো, প্রথমে, উইদিন সেকেন্ডস, বিকট একটা শব্দ হলো। মনে হলো বোমা হামলা হয়েছে। গ্রেনেড হামলা হবে সেটা ভাবতে পারিনি। শেখ হাসিনার জনসভায়, বঙ্গবন্ধু কন্যার জনসভায় প্রকাশ্যে এরকম গ্রেনেড হামলা হবে এটা কখনও কল্পনায়ও ছিল না। হুমকিতো সব সময়ই ছিলো, কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে হামলা ভাবাই যেত না। আমার ভাবনায় প্রথম এলো, দুই গ্রুপের মারামারি বা এরকম কিছু হয়েছি কি না, এগুলা চিন্তা করতে করতে দেখি মানুষের চেচামেচি, চিৎকার, হুলস্থূল অবস্থা। আমি ততক্ষণে নিচে পড়ে গেছি। এদিকে পাবলিক দৌড়াদৌড়ি করছে। আমার উপর দিয়ে অনেক মানুষ মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। যেহেতু ট্রাকের পাশে ছিলাম আমি চাকাটা ধরে ট্রাকের নিচে শুয়ে পড়লাম। ওখানে শুয়ে আমি মোবাইলটা বের করলাম, চিত হয়ে শুয়ে আমাদের তখন চ্যানেল আইয়ের হেড অব নিউজ শাহ আলমগীর (বর্তমানে প্রয়াত), উনাকে কল দিলাম। তখনও গ্রেনেডের আওয়াজ আসছে। আলমগির ভাই বলছেন- কী হয়েছে কী হয়েছে? আমি বললাম আপনি- টিভিতে স্ক্রল দেন, শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলা হয়েছে। উনি একজনকে ডেকে টিকার দিতে বললেন। দিস ইজ জার্নালিজম, উনি আমার অবস্থা জিজ্ঞাস করার আগে, টিকার দিতে বললেন। এরপর আমার কাছে জানতে চাইলেন তোমার কী অবস্থা? আমি বললাম- ট্রাকের নিচে শুয়ে আছি। জানতে চাইলেন- ইনজিউরড হয়েছি কিনা। এবার আমি তাকালাম নিজের শরীরের দিকে, তখন দেখি যে আমার দুটো পায় জিনসের মোটা কাপড় ভেদ করে ছোপ ছোপ রক্ত। ছোটগুলো ক্রমশই বড় হচ্ছে চোখের সামনেই। তখন আমি উনাকে বললাম আমার অবস্থা ভালো না, বলেই আমি ফোনটা কেটে দেই।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি বের হওয়ার পর হঠাৎ আমার সামনে একটি টিয়ারশেল এসে পড়লো। স্টেডিয়ামের দিক থেকে আসে সেটি। টিয়ারশেল জীবনে অনেক সহ্য করেছি, কিন্তু টিয়ারশেলের প্রথম ধোয়াটা বেশ বিপদজনক। ধোয়ার প্রথম কুণ্ডলীটা আমার মুখের মধ্যে এসে ঢুকছিলো। তখন আমি দুই হাত দিয়ে আমার মুখ ঢেকে রাখি। আমি জানতাম এরকম আহত অবস্থায় বমি হওয়াটা খুব ক্ষতিকর। আমার কপাল চোখ খুব জ্বলছিল। এখন দেখলাম এখান থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। প্রচুর লোকজন দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি আবার ক্রল করে করে আওয়ামী লীগের অফিসের দিকটায় গেলাম। হঠাৎ দেখলাম আমার পায়ের কাছে কিছু একটা। ভালো করে তাকিয়ে দেখি সেটি একটি গ্রেনেড। তখন আর ধরে প্রাণ ছিলো না! কারণ গ্রেনেডের বিষয়ে জানি, পিন খোলার পর বেশিক্ষণ লাগে না ব্লাস্ট হতে। এটা দেখার পর আমি বাঁচার আশা ছেড়ে দেই। যে কোনও মুহূর্তে এটা বিস্ফোরিত হবে। এতটাই বিচলিত হয়ে গিয়েছিলাম যে চোখের সামনে নিজের মৃত্যুই দেখতে পাচ্ছিলাম।
নীলা চৌধুরী :
একুশে আগস্টের রক্তাক্ত হামলায় আহত মানুষের একজন। ২০০৪ সালে নীলা ছিলেন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলাবিষয়ক সহ-সম্পাদিকা। এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন শতাধিক স্প্লিন্টার। চোখ বন্ধ করলে এখনো তাকে তাড়া করে ফেরে সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি।
সাবিহা :
গ্রেনেড হামলার আরেক শিকার মহিলা আওয়ামী লীগকর্মী সাবিহার দিনও কাটছে শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার ও দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে। তার ক্ষতবিক্ষত ডান পা ও ডান হাত এখনো সেদিনের বিভীষিকার সাক্ষ্য দিচ্ছে। সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের তীব্র যন্ত্রণায় তিনি প্রতিনিয়ত কাতর। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন এই সংগ্রামী মানুষটিও। ঠিকভাবে চলাফেরা ও সংসারের কাজ করতে না পারায় হোটেল শ্রমিক স্বামী হেলাল ঘটনার পরপরই তাকে তালাক দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেন।
আশিক মোহাম্মদ আরশেদ আলী :
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা আশিক মোহাম্মদ আরশেদ আলী এখন বেসরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। গ্রেনেড হামলায় দুই পা ছাড়াও মেরুদণ্ড, তলপেট, মাথাসহ দেহের বিভিন্ন অংশে তিনি অর্ধশতাধিক স্প্লিন্টারবিদ্ধ হন। এখনো শরীরজুড়ে সেই স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
বিএনএনিউজ/এইচ.এম।