24 C
আবহাওয়া
১০:৫২ অপরাহ্ণ - নভেম্বর ২১, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » জবানবন্দিতে কী বলেছে হল-মার্কের তানভীর?

জবানবন্দিতে কী বলেছে হল-মার্কের তানভীর?


বিএনএ, ডেস্ক : সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ ৩ হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে একা হল-মার্কই তুলে নেয় ২ হাজার ৬৬৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। একটি ব্যাংকের একটি শাখায় একটি কোম্পানির এই পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা আগে ঘটেনি।

এক যুগ পর হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, জেসমিন ইসলামসহ নয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। কীভাবে ঘটেছিল হলমার্ক কেলেঙ্কারি?

হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় মামলা হয়েছিল একাধিক। এর মধ্যে একটি মামলায় ২০১২ সালের ১৮ আগস্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তানভীর মাহমুদ। নিজেকে অনেকটা নির্দোষ দাবি করলেও কেলেঙ্কারির নানা বিবরণ দিয়েছিলেন সেই জবানবন্দিতে।

হল-মার্ককে প্রথম ঋণ দিয়েছিল পরিচালনা পর্ষদই। এই সুযোগ নিয়ে রূপসী বাংলা শাখা নিয়মিতভাবে হল-মার্ক গ্রুপকে জালিয়াতি করতে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ কর্মকর্তা এই জালিয়াতির সুযোগ করে দেন। জালিয়াতির ঘটনা যাতে উদ্‌ঘাটিত না হয় সে জন্য কয়েকজনকে বদলি করা হয় এক দিনের নোটিশে।

রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক উপমহাব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবীরসহ ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাই। আজিজুর রহমান আটক অবস্থায় মারা গেছেন।

তানভীর মাহমুদ জবানবন্দিতে বলেন. ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে বাবার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে—পাঁচ হাজার টাকা ভাড়ায়, ২৫ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে কাফরুলের ১৯০/২ তালতলায় হল-মার্ক প্যাকেজিং ফ্যাক্টরি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ২০০৮ সালে ৮–৯টি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে হল-মার্ক গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তার ৬৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্টস ৩৪টি। প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ২০০৪–০৫ সালের দিকে গার্মেন্টস থেকে লোকাল ব্যাক টু ব্যাক এলসি পাওয়ার পর সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখায় হল-মার্ক প্যাকেজিংয়ের নামে হিসাব খোলেন। ওই শাখায় হলমার্ক গ্রুপের ৫৭টি হিসাব রয়েছে।

তানভীর বলেন, সাইফুল ইসলাম রাজা আগে তানভীর মাহমুদের জিএম ছিল। পরে প্যারাগন গ্রুপের মালিক হয়। আবদুল মালেক ছিলেন পরিচালক। সে নকশি নিট কম্পোজিট নামে গোপনে ব্যবসা শুরু করে। তসলিম হাসান টি অ্যান্ড ব্রাদার্স গ্রুপের পরিচালক। তানভীর মাহমুদের পক্ষে সব ব্যাংক হিসাব দেখত রাজা ও মালেক। অনেক সময় তিনি তাদের কাছে ব্যাংক চেক দিয়ে রাখতেন। তসলিম হোসেন আগে থেকেই ভুয়া এলসির কাজ করত।

তারা আমার কোম্পানির এলসি থেকে ৩০–৪০% কমিশন খেয়ে আমার দেনা বাড়ায়। এরা প্রত্যেকে গোপনে কয়েকটা করে ইন্ডাস্ট্রি করেছে।

সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখার সাবেক ম্যানেজার আজিজ, এজিএম সাইফুল হাসান ও ব্যাংকের সাবেক অফিসার মতিন, অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ওয়াহিদুজ্জামান ক্যাশ অফিসার সাইদুরের এসব কাজে যোগসাজশ ছিল। বিভিন্ন দফায় সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের এমডি আতিকুর রহমান, কার্যালয়ের জিএম ননী গোপাল, মীর মহিদুর, ডিএমডি সাইফুল ইসলাম, জিএম সিরাজী ফেব্রুয়ারি ২০১২–এর দিকে তাকে ডেকে নেন। সেখানে সব দায় স্বীকার করেন তানভীর।

২০১২ সালে সম্ভবত এপ্রিলে তসলিম, মালেক, রাজা, ম্যানেজার আজিজ সাহেব, ডিএনএ স্পোর্টসের মালিক শিখা তাকে ব্যাংকের বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ম্যানেজ করতে তিন কোটি টাকা লাগবে।
২৪ মে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে সব ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে বলে টাকা সমন্বয় করতে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত তানভীর মাহমুদ বিভিন্নভাবে ৪৫২ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। একই সঙ্গে ৬১ একর জমি বন্ধক দেন। যার বাজারমূল্য ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন জায়গায় ২৪টি চিঠি দিয়ে ব্যবসা চালু করাসহ টাকা পরিশোধের জন্য ২০ বছর কিস্তি চান তানভীর মাহমুদ। কিন্তু কোনো চিঠির উত্তর পাননি। তবে দুদকের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ব্যাংক একটি চিঠি দিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধের চিঠি দেয়। যা অবাস্তব বলে উত্তর দেন তিনি।

তানভীর তার জবানবন্দিতে বলেন তিনি কোনো টাকা বিদেশে পাচার করেননি। শুধু ইন্ডাস্ট্রি করেছেন। জীবনে চিকিৎসার জন্য শুধু একবার সিঙ্গাপুর গিয়েছেন।

তানভীর মাহমুদ আরও বলেন, জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংক ম্যানেজার আজিজ, এজিএম সাইফুল হাসান, অফিসার মতিন, ওয়াহিদুজ্জামান, ক্যাশ অফিসার সাইদুর জড়িত ছিল। পরবর্তীতে তারা জিএম তুষারের মাধ্যমে তসলিম, রাজা ও মালেক—এই তিনজন ব্যাংকের কাঁচা রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি করে শাখার কর্মকর্তাদের আনুমানিক তিন কোটি টাকা দেন। সোনালী ব্যাংক জিএম কার্যালয়ে তসলিম, রাজা ও মালেক—তিনজন জিএম মীর মহিদুর ও অফিসার ওয়াহিদুজ্জামানকে প্রায় সময়ই ২–৫ লাখ টাকা করে মোট ৮০–৯০ লাখ টাকা দিয়েছেন।

জিএম ননী গোপাল কাজে যোগদানের ১৫ দিন পর তানভীরকে অফিসে ডেকে নিয়ে তার চিকিৎসার জন্য পাঁচ লাখ টাকা সাহায্য চায় এবং তার মেয়ের জন্য একটি ই-৭১ মোবাইল চায়। আমি ১৫ দিনের মধ্যে ওই টাকা ও মোবাইল সাহায্য হিসেবে দেই। সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের আইটিএফডি বিভাগের সাবেক এজিএম বর্তমান ডিজিএম সফিজউদ্দিনকে ডিজিএম আজিজ, তসলিম, মালেক, রাজা, সপ্তাহে এক লাখ টাকা করে মোট ৭০-৮০ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে আমাকে হিসাব দেয়। এ ছাড়া প্রধান কার্যালয়ের ডিএমডি আতিকুর রহমানকে তানভীর ম্যানেজার আজিজের কথামতো চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ টাকা দেন।

২০১২ সালে সম্ভবত এপ্রিলে তসলিম, মালেক, রাজা, ম্যানেজার আজিজ সাহেব, ডিএনএ স্পোর্টসের মালিক শিখা তানভীরকে ব্যাংকের বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ম্যানেজ করতে তিন কোটি টাকা লাগবে। এবং এটা বোর্ড সদস্য একজনকে দিতে হবে। একপর্যায়ে রেগে যান তানভীর মাহমুদ। পরে তসলিম সাহেব বলে, “আমি নিজে দেব ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, হল-মার্ক দেবে ১ কোটি এবং বাকি ৮০ লাখ মালেক, রাজা ও শিখা দেবে।” আজিজ সাহেবসহ এরা সবাই তানভীরকে ফোন করে টাকার বিষয়ে খুব বিরক্ত করতে থাকে। তসলিম বলে, সে নাকি ইতিমধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে দিয়েছে।

একপর্যায়ে তুষারের মাধ্যমে তানভীর ৫০ লাখ টাকা দেন। কদিন পর তসলিম ও এক পরিচালক তার বাসায় গিয়ে বাকি ৫০ লাখ টাকা চায়। তানভীর রাগারাগি করে দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তসলিম অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে তসলিমকে অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ বলেন, আজিজ সাহেব সব জেনেই তাদের আলাদাভাবে লোন দিয়েছে, বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে। আনোয়ার স্পিনিং, ম্যাক্স স্পিনিং, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজ, স্টার স্পিনিং মিলস—রাজা ও মালেক সাজিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তসলিম বিভিন্ন সময় তানভীরকে ডিজিএফআই ও সাংবাদিকের কথা ভয় দেখাত বলে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

তানভীর জবানবন্দির শেষে উল্লেখ করেন সরকারি নিয়মের কারণে লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে দুজন লাগে বিধায় তার স্ত্রীকে পরিচালক করেছেন। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। সে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত নয়।

বিএনএ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী, ওজি/হাসনা

Loading


শিরোনাম বিএনএ