।। মাহমুদুল হাসান।।
বিএনএ ডেস্ক: একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি এখন আর বাঙালির একার নয়, পুরো বিশ্বের। আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার অধিকার পাকিস্তানি জান্তারা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। লুণ্ঠন করতে চেয়েছিল বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-গর্বের শ্রেষ্ঠ স্থানটি। কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেরা তা হতে দেননি। বুকের রক্ত দিয়ে তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন মাতৃভাষার সম্মান। ১৯৫২ সালের এই দিনে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল মাতৃভাষা বাংলার অধিকার।
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি আমাদের জীবনে নতুন নতুন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়। অন্য ১১ মাসের চেয়ে ফেব্রুয়ারির আবেদন ভিন্ন আমাদের কাছে। সাংস্কৃতিক বিবেচনায় অত্যন্ত পবিত্র এই মাস। ফেব্রুয়ারি আমাদের অধিকার সচেতন হতে শিখিয়েছে। পৃথিবীর শুরু থেকে কত হাজারও ঘটনা নিয়ে যুদ্ধ ও জীবন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভাষার জন্য জীবন দেয়ার ইতিহাস একমাত্র আমাদেরই। এজন্যই ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের গর্ব ও অহংকার।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের অমলিন রক্তযুক্ত স্মৃতি স্মরণের মাস ফেব্রুয়ারি। বাঙালির কাছে এই মাস ভাষার মাস, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়ার মাস। তাই বাঙালি জাতি নানা আয়োজনের মাধ্যমে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ভালোবাসা জানায় ভাষা শহীদদের প্রতি। ১৯৫২ সালে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করেন।
মায়ের ভাষা কেড়ে নেওয়ার এই সংগ্রামে সেদিন ছাত্র-জনতা একসঙ্গে রাজপথে নেমে পড়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষা নিয়ে এমন আন্দোলন আর কোথাও হয়নি। ভাষার জন্য এই আত্মত্যাগ পৃথিবীতে বিরল। এই আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। তারপর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে।
ভাষার মাসের অন্যতম আকর্ষণ হলো বইমেলা। এই মাসে রাজধানীর বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী এ আয়োজনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭২ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি বাবু চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধমান হাউজ এলাকায় বইমেলা শুরু করেছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রীর ছোটবোন শেখ রেহানাও উপস্থিত ছিলেন।
মানবদেহের যে মনোজগৎ তার প্রধান খাদ্য হলো বই থেকে আহরিত জ্ঞান, যা একজনকে আলোকিত করে, উজ্জীবিত করে এবং বস্তুকেন্দ্রিক জীবনবোধ থেকে বের করে আনে। বইমেলায় এসে অনেকে বই কেনেন। এর প্রভাব পড়ে মেলায় আগত মানুষের ওপর। যে কোনো মেলায় সমবেত হওয়ার মননগত প্রবণতা আছে বাঙালির। মেলায় মিলিত হওয়ার যে আনন্দ, তা অন্যত্র পাওয়া যায় না। বইমেলায় বই কেনার গরজেই শুধু মানুষ আসেন না, আসেন সাংস্কৃতিক পীঠস্থান, উৎসবে মিলিত হওয়ার আনন্দেও। বইও কেনেন।
যারা মেলা থেকে বই কেনেন, তারা কেউ কেউ হয়ত কোনোদিনও বই বিপণিতে গিয়ে বই কিনতেন না। এটাই বইমেলার গুরুত্ব। বই পড়ার আনন্দ তীব্র। বই পড়ার মধ্যে আনন্দই পেতে চায় সবাই। আনন্দ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। বই পড়ায় নেশাও আছে। দুটো অভ্যাসেরই দরকার বই পড়া ও কেনার। বইয়ের জগৎ ভিন্ন এবং মানুষও ভিন্ন।
প্রতিদিনই বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টকশো চলছে বইমেলার বিভিন্ন নান্দনিক ও মানবিক দিক নিয়ে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, বইমেলা প্রাণের মেলা থেকে সরে আসছে কিনা? কারণ, কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা দেওয়ার সে জায়গাটি, তা অনেকাংশে সংকুচিত হয়ে আসছে নিরাপত্তাজনিত কারণে। আবার যারা প্রতিষ্ঠিত বয়োজ্যেষ্ঠ কবি ও সাহিত্যিক, তাদের আগের মতো মুক্ত হাওয়ায় পদচারণার উৎসাহটি তেমন চোখে পড়ে না। অনেকেই বলছেন, বই প্রকাশের ওপর নজরদারি ও পুলিশি তৎপরতা অনেকাংশে এই সার্বিক পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে প্রতীয়মান।
ভালো সাহিত্য কিংবা জনপ্রিয় সাহিত্য অথবা ভালো বই কিংবা জনপ্রিয় বই এক কথা নয়। এখন অনেক লেখক কবিতা কিংবা উপন্যাস কিংবা ছড়া লিখে চলছেন এই আশায় যে, তিনি একুশে বইমেলায় একটি বিশাল প্রচার পাবেন, অর্থাৎ বইমেলার লেখক কিংবা কবি সৃষ্টিতে একটি অবদান রয়েছে সত্যি। কিন্তু মান নিয়ে বড় আশঙ্কায় সাহিত্য সমালোচক সমাজ, যা ক্রমাবনতিশীল। তাই এই ধরনের বই ও বইয়ের মেলা আমাদের সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে কতটুকু ভূমিকা রাখছে বা রাখবে আগামী দিনগুলোতে? এই প্রশ্নগুলোর সমাধান খোঁজা জরুরি।
মানসম্মত বইয়ের পাঠক সারাবছর থাকে। অনেক পাঠক আছে, মেলায় এসে খুঁজে খুঁজে ভালো লেখকদের বই কেনে। তবে বই যেহেতু সৃজনশীলতার অন্যতম ধারক-বাহক, সে ক্ষেত্রে বইমেলায় বই কিনতে যায় নির্দিষ্ট কিছু পাঠক; বাকিরা যায় ঘুরতে। বইমেলায় ভালো বইয়ের পাশাপাশি আসে অনেক মানহীন বই। সেসব বই মেলার মানকে ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অসংখ্য নতুন লেখক তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে মেলা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকেন আর পরিচিত মানুষ দেখলেই তাদের হাতে বই ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকে আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের বন্ধুবান্ধবকে আমন্ত্রণ করে বইমেলায় নিয়ে এসে তাদের হাতে মানহীন বই ধরিয়ে দেন।
অনেক লেখক আছেন, নিজের নামের পাশে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বেশি দেখানোর জন্য বই প্রকাশ করেন। হোক সে বই মানহীন কিংবা ভুলে ভরা। প্রকৃতপক্ষে বইমেলায় আমরা ভালো মানের বইয়ের সমাহার দেখতে চাই। সেখানে কোনো পাঠককে জোর করে গছিয়ে দিতে হবে না, পাঠক নিজেই বই খুঁজে নেবে। পাঠক বইমেলায় গিয়ে অত্যুৎসাহে বই কিনবে। তবে নতুন লেখকরা যে বই প্রকাশ করবেন না, তেমনটা নয়। বইমেলায় নতুন লেখকদের বই প্রকাশ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে তারা যেন খুব ভালোভাবে পড়াশোনা করে এবং মেধা খাটিয়ে তারপর বই প্রকাশ করেন। এতে একজন লেখক তাঁর লেখা বইয়ের মাধ্যমে মেধার উৎকর্ষতা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন।
আমরা চাই বইমেলার মাধ্যমে মানসম্মত বইসহ মেধাবী লেখকরা পরিচিত পান। শুধু একজন লেখক হিসেবে পরিচিতির জন্য বই প্রকাশ না করে উচিত হবে কীভাবে তাঁর লেখা পাঠকের মনে দাগ কেটে যায়, সে চিন্তা করা। এ বোধ লেখক এবং পাঠকের মধ্যে ভালোবাসার সেতুবন্ধন তৈরি করতে বাধ্য। লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের সম্মিলিত অবদানই পারে একটি বইকে জনপ্রিয় করে তুলতে। এ ক্ষেত্রে বইটির লেখককে অবশ্যই মেধাবী হতে হবে। বইমেলা যেহেতু প্রতিবছর ঘুরেফিরে আসে, সেহেতু প্রত্যেক লেখকের উচিত বই দেখেশুনে এবং পাঠকপ্রিয়তা পায় এমনভাবে প্রকাশ করা। তাড়াহুড়ো করে বই প্রকাশ করতে গিয়ে যেন নিজের সৃষ্টিশীলতা বাঁধার সম্মুখীন না হয়, এ বিষয়ে নতুন লেখকদের ভাবা উচিত।
ভাষা আন্দোলনের এক বছর পর যদি আমরা হিসাব করি কতটা পথ এগোলাম, তবে দেখব লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমাদের এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। আমরা শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করতে চাই। সেই প্রত্যাশায় সব শিশুকে বিদ্যালয়ে আনার চেষ্টা সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চলমান রয়েছে। তবে তার ফলাফলটার দিকে একটু দৃষ্টি দিতে চাই।
বাংলাদেশের একটি গ্রামের শতবর্ষী বিদ্যালয়ে যখন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে জিপিএ ৫ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রী ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে আসে, তখন তাদের ইংরেজি এ বি সি ডি থেকে শুরু করাতে হয়। বাংলায় অনেকেই নিজের নামটিও ঠিকমতো লিখতে পারে না। এ চিত্র নিশ্চয়ই সব জায়গার নয়। কিন্তু একটি কথা স্বীকার করতেই হবে যে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার মান মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। অথচ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অবকাঠামো ও শিক্ষক খাতে সরকার একটা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। কিন্তু গুণগত শিক্ষা ছাত্র-ছাত্রীরা লাভ করছে না। অনেক স্কুলেই অভিযোগ শুনি, শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস নেন না, তাঁদের তদারকি যথাযথভাবে হয় না। অথচ প্রাথমিক শিক্ষার ভিত যদি আমরা ঠিক করতে না পারি, তবে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই একটা দুর্বল কাঠামোর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে। আমাদের প্রত্যাশা, পাসের হার নিয়ে উল্লাসিত হওয়ার চেয়ে আমরা গুণগত শিক্ষার ওপর জোর দেব।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে আমাদের এখন বিশেষ জোর দিতে হবে। অবশ্য সরকার মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি করার জন্য নানা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
উচ্চ আদালতসহ দেশের সব বিচারিক কার্যক্রমে বাংলা ব্যবহারের দাবি দীর্ঘদিনের। কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে সব আইন বাংলায় করা সম্ভব না হলেও আদালতে সওয়াল-জবাব ও রায় প্রদানে বাংলা ব্যবহৃত হতে কোনো বাঁধা নেই। অভাব শুধু মানসিকতার, ইচ্ছার। আদালতে বাংলা প্রচলিত হলে বিচারপ্রার্থীরা বিশেষভাবে উপকৃত হবে।
ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলা ভাষার মাস নয়, বাঙালি সংস্কৃতি উদযাপনের মাসও। পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে যায় বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা। আজ সেই মেলা এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বর ছাড়িয়ে মেলা এখন বিস্তৃত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। প্রতিবছরই নতুন নতুন প্রকাশক যুক্ত হচ্ছেন, মেলার পরিধি বাড়ছে। অমর একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্প বিকশিত হয়েছে। মেলা উপলক্ষ্যে প্রকাশকরা নতুন বইয়ের সম্ভার নিয়ে আসেন। মেলায় নগদ বিক্রি হয় বলে বিনিয়োগ করা অর্থ দ্রুত ফিরে আসে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই যে বইমেলায় হাজার চারেক নতুন বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে কতগুলো মানসম্পন্ন? প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা আছে বই প্রকাশ করার, এখানে মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একমাত্র প্রকাশকরাই পারেন নিজেদের প্রকাশিত বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ করতে। বইয়ের ব্যবসাকে আলু-পটোলের ব্যবসার সঙ্গে এক করে দেখলে হবে না। মানসম্পন্ন না হলে সেই বই প্রকাশক কেন প্রকাশ করবেন? অথচ আমরা অহরহ লক্ষ্য করি ভুল বানানে, ভুল বাক্য গঠনে নিম্নমানের বই প্রকাশিত হয়ে চলেছে। বিষয়বস্তুর কথা বাদই দিলাম। প্রতিটি বই প্রকাশনার আগে সম্পাদনার দাবি রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ প্রকাশকই সম্পাদনার ওপর গুরুত্ব দেন না।
বইয়ের দাম যতই বেশি হোক না কেন, বই কিনে তো কেউ দেউলিয়া হয় না। তবুও সকলে বইমেলায় আসছে, আসবে, বই কিনবে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশা সকলের।
বিএনএ/ ওজি /এইচমুন্নী / হাসনা