28 C
আবহাওয়া
৬:৩৩ অপরাহ্ণ - নভেম্বর ২১, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » চেয়ারম্যান হারুনের যোগসাজশে ২শ একর বনভূমি দখলে নেয় সালমান গং!

চেয়ারম্যান হারুনের যোগসাজশে ২শ একর বনভূমি দখলে নেয় সালমান গং!

বাঁশখালীতে চেয়ারম্যানের যোগসাজশে ২শ একর বনভূমি দখলে নেয় সালমান এফ রহমান

বিএনএ,চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে প্রায় দুই শত একর বনভূমি প্রভাবশালীদের দথলে রয়েছে।। জাল বিএস খতিয়ান করে  প্রভাব খাটিয়ে এসব জমি দখলে রেখেছে তারা। । বর্তমানে বনভূমির এসব জায়গায় পুকুর খনন করে মাছ চাষ, চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষ করা হচ্ছে। । অর্ধশত বছর আইনী লড়াইয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় পাওয়ার পরও এখনো ওই জমি উদ্ধারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন।

উপকূলীয় বন বিভাগের ছনুয়া রেঞ্জ এর খুদুকখালী মৌজায় সাগরতীরের ভূমিতে ২০০৭, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বিভিন্ন ধাপে ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন করা হয়।

অভিযোগ আছে, ২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে ৮০/৯০ জন লোক উপকূলীয় বন বিভাগের ১ লক্ষ ৮০ হাজার গাছ কেটে ২০০ একর জমি দখল করে নেয়। আনুমানিক ২ কোটি টাকা মূল্যের বাইন ও কেওড়া গাছ কেটে সন্ত্রাসীরা ওই জায়গায় চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষের জন্য অবৈধভাবে ঘের স্থাপন করে। এ ঘটনায় বাঁশখালী থানায় মামলা নং-০১/২০০৯ দায়ের হয়। পরবর্তীতে আসামিদের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করে। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষের ক্ষেত্র প্রস্তুত, স্ক্যাভেটর দিয়ে পুকুর খনন, লোনা পানি প্রবেশ ও লেবার শেড নির্মাণ করায় ২০১১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বন বিভাগের বিট কর্মকর্তা বাঁশখালী থানায় মামলা নং-৮/৩৪ দায়ের করেন।

উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, খুদুকখালী মৌজার ৬ ও ১০০১ দাগের প্রায় ৯০ একর জমির সরকারি বিজ্ঞপ্তি নং- ফর-১৩- ১৯/৮৪/৯০৮ মূলে বন বিভাগকে হস্তান্তর করা হয়। একই দাগের প্রায় ১৬ একর জমির বন আইনের ৬ ধারা জারি করে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং- ৮-৪৬১/৮৬/৫৪ তারিখ ২/২/৮৮ মূলে ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশনের ইজারা বাতিল এবং বন বিভাগের অনুকূলে হস্তান্তর করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর জাল বিএস খতিয়ান তৈরি করে উপকূলীয় বন বিভাগের ছনুয়া রেঞ্জ এর খুদুকখালী মৌজার ১নং খাস খতিয়ানের ৯৯ একর জমি বিক্রি করে দেন ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও সাবেক চেয়ারম্যান বশির আহমদের ছেলেরা। বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান এস্কর্প হোল্ডিংস লিমিটেড এর পক্ষে ওই জমি কিনে নেন। আইনি লড়াইয়ে উপকূলীয় বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন উক্ত জমি ফিরে পেলেও এখনোও দখলমুক্ত করতে পারেনি। সালমান এফ রহমানকে জায়গা বিক্রির পর আঙুল ফুলে কলা বনে যান ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ। হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ১২ মামলার আসামি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ২০১৭ সালে বেড়ার কুঁড়েঘর ভেঙে ১৫০ শতক জায়গার ওপর ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাউন্ডারি ওয়াল সম্বলিত ৫ তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবন নির্মাণ করেন। এছাড়াও তার চাচা, সাবেক চেয়ারম্যান বশির আহমদের ছেলেরাও বহুতল ভবন গড়ে তুলেছেন।

মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উপকূলীয় বন বিভাগের ছনুয়া রেঞ্জ এর খুদুকখালী মৌজার খাস খতিয়ানভুক্ত ৯০ একর জমি নারকেল বাগান করার শর্তে ২৫ বছরের জন্য ইজারা নেয় ‘ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। জেলা প্রশাসন ১৯৬৬ সালে শীষ মোহাম্মদ ও বশির আহমদকে এই ইজারা দেয়। কিন্তু নারকেল বাগান না করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘের এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেন। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করার অভিযোগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ১৯৬৭ সালে ইজারা বাতিল করেন। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে ইজারাগ্রহীতারা ভূমি আপিল বোর্ডে আপিল করেন। বোর্ড ইজারাদারকে লবণ মাঠ না করে নারকেল বাগান করার নির্দেশ দিয়ে ইজারা বহাল রাখেন। এসব জমি ইজারা দেওয়া ও বাতিল নিয়ে বিভিন্ন সময় ইজারাদার পক্ষ ও জেলা প্রশাসন আইনি লড়াইয়ে যুক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারি জমির ইজারা বাতিল করে জেলা প্রশাসনের পক্ষে রায় দিয়ে ওই জমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন প্রশাসনের কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে জমির স্থায়ী বন্দোবস্তের খতিয়ান সৃজন করে। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে জানার পর জেলা প্রশাসকের পক্ষে সরেজমিনে তদন্ত করা হয়। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন ১৯৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি বিভাগীয় কমিশনার বরাবর পাঠায়। চিঠিতে জমির ইজারা বাতিল এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন বিভাগে অভিযোগ করার কথা বলা হয়।

এর আগে ইজারা বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন ১৯৮১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলা করে। চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারী জজ আদালত ১৯৯১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইজারাগ্রহীতার পক্ষে রায় দেন। প্রশাসন নিম্ন আদালতের এই আদেশ খারিজ করার জন্য জেলা জজ আদালতে মামলা করে। শুনানি শেষে জেলা জজ আদালত ১৯৯৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রশাসনের আবেদন বাতিল করেন। নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৫ সালে প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিভিশন মামলা দায়ের করে। নানা ধাপ শেষে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট আপিল বিভাগ ইজারা চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেন।

উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আপিল বিভাগের আদেশ কার্যকর করার জন্য ২০১৮ সালের ১১ মার্চ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবর চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে ৯৯ একর জমি পুনরুদ্ধারের অনুরোধ জানানো হয়। ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জমির বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানানোর জন্য একটি চিঠি সহকারী কমিশনার (ভূমি) বাঁশখালীকে পাঠানো হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাহমুদ উল্লাহ মারুফ ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। চিঠি পাঠানোর ৭ বছর পরও চিঠির উত্তর পাওয়া যায়নি।

এদিকে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর জমিগুলো দখলমুক্ত করতে নড়েচড়ে বসে উপকূলীয় বন বিভাগ। গত ২৬ আগস্ট ওই জমিতে দখলমুক্ত ঘোষণা করে লাল পতাকা উত্তোলন করে বন বিভাগের লোকজন। কিন্তু সেখানে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে উত্তোলন করা পতাকা ছিঁড়ে ফেলেন ছনুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের অনুগত হেফাজুল করিম, মফিজুল করিম ও শাহাদাত করিম নামের তিন ব্যক্তি।

স্থানীয় বাসিন্দা আবু সিদ্দিক মাস্টার বলেন, খাসজমিগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে লবণ চাষ ও বর্ষা মৌসুমে চিংড়ি ঘের করা হয়। বন বিভাগের লোকজনের দাবি তাদের কাছে জনবল কম। ছনুয়ার সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক চৌধুরী দখল উচ্ছেদ অভিযানে ২ হাজার লোক দিয়ে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিলেও বন বিভাগের কর্মকর্তারা দখল বুঝে নিতে রাজি হননি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানার জন্য ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদকে কল করা হলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে হারুন আত্মগোপনে আছেন।

উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, বন বিভাগের ওই জায়গায় আমাদের পক্ষে হাইকোর্টের রায় আছে। স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান লোক দেওয়ার কথা বললেও ওখানে গিয়ে লোক নিয়ে মারামারি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। ওখানে উচ্ছেদ অভিযান করা আমাদের কাজ নয়। উচ্ছেদ অভিযানের জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। চিঠির জবাব আমরা এখনোও পর্যন্ত পাইনি।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার বলেন, বেদখল থাকা বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসন থেকে এখনোও পর্যন্ত নির্দেশনা পাইনি। জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিএনএনিউজ/ নাবিদ/ হাসনা/এইচমুন্নী 

Loading


শিরোনাম বিএনএ