বিএনএ ডেস্ক: মহান আল্লাহ তা‘আলা কিছু মাস, দিন ও রাতকে ফজিলতপূর্ণ করেছেন। যেমন রমজান মাসকে অন্য সকল মাসের উপর মহিমান্বিত করেছেন। আরাফাতের দিন ও ঈদের দিনকে অন্য দিনের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। ক্বদরের রাতকে অন্যান্য রাতের চেয়ে মর্যাদামন্ডিত করেছেন। জিলহজ মাস অনুরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মাস। যে মাসে হজ ও কুরবানী করা হয়ে থাকে। এই মাসের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদিসে বিস্তর আলোচনা এসেছে। জিলহজ মাসের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে জেনে নিই।
জিলহজ মাসের ফজিলত
উম্মতে মুহাম্মাদীর বয়স ষাট থেকে সত্তর বছর। এত্থেকে অধিক বয়স কম লোকেরই হয়। তাই অল্প সময়ে অধিক নেকী উপার্জনের জন্য মহান আল্লাহ বিভিন্ন মাস ও দিবসকে ফজিলতপূর্ণ করেছেন। অনুরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস হচ্ছে জিলহজ মাস। এ মাসেরও অনেক ফজিলত রয়েছে।
১। এটা হারাম মাস: চারটি হারাম তথা সম্মানিত মাসের মধ্যে অন্যতম হল জিলহজ মাস। মহান আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয়ই মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে বার মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি মাস হচ্ছে সম্মানিত। এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন’ (তওবা ৯/৩৬)।
আবূ বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যেদিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন হতে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। যুল-কা‘দাহ, যুল-হিজ্জাহ ও মুহাররাম। তিনটি মাস পর পর রয়েছে। আর একটি মাস হ’ল রজব-ই মুযার, যা জুমাদা ও শা‘বান মাসের মাঝে অবস্থিত’।
২। এটা হজের মাস: ওমরার জন্য সারা বছর সুযোগ থাকলেও হজের জন্য শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত মাস রয়েছে। হজের মাস সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হজ হয় সুবিদিত মাসগুলিতে। তারপর যে কেউ এ মাসগুলিতে হজ করা স্থির করে সে হজের সময় স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ করবে না’ (বাক্বারাহ ২/১৯৭)। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, হজের সুবিদিত মাসগুলি হ’ল শাওয়াল, জিলক্বদ ও জিলহজ। আল্লাহ এ মাসগুলি হজের জন্য নির্ধারণ করেছেন। আর ওমরা সারা বছর আদায় করা যায়। এ মাসগুলি ব্যতীত হজের জন্য ইহরাম বাঁধলে হজ হবে না।
৩। এটা কোরবানীর মাস: কোরবানীর একমাত্র মাস হল জিলহজ মাস। এই মাসের ১০ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত মোট চারদিন কোরবানী করার সময়। প্রথম দিন তথা ১০ই জিলহজ সালাতুল ঈদের পর কোরবানী করতে হবে। ঈদের সালাতের আগে কোরবানী করলে কেরবানী হবে না। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাতের পূর্বে যবহ করেছে, সে যেন তদস্থলে আরেকটি যবহ করে নেয়। আর যে ব্যক্তি আমাদের সালাত আদায় করা পর্যন্ত যবহ করেনি, সে যেন এখন আল্লাহর নাম নিয়ে যবহ্ করে’।
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের ফজিলত
জিলহজ মাস পুরোটাই ফজিলতপূর্ণ হলেও প্রথম দশ দিনের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। যেমন-
১। আল্লাহ এই দিনগুলির কসম করেছেন: মহান আল্লাহ কুরআনে বিভিন্ন বিষয়ের কসম করেছেন। জিলহজ মাসের দশ দিনের কসম করে আল্লাহ বলেন, ‘শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির, শপথ জোড় ও বেজোড়ের’ (ফজর ৮৯/১-৩)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দশম হল ঈদুল আযহার দিন, বেজোড় হল আরাফার দিন আর জোড় হল কুরবানী দিন’।
২। বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন: জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়ার দিন সমূহের মধ্যে জিলহজের প্রথম দশদিন সর্বোত্তম দিন’।
৩। এই দিনগুলির আমল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এমন কোন দিন নেই যে দিনসমূহের নেক আমল আল্লাহর নিকট জিলহজ মাসের এই দশ দিনের নেক আমল অপেক্ষা বেশি প্রিয়। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আল্লাহর পথে জিহাদ করাও কি নয়? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, জিহাদও নয়। তবে জান-মাল নিয়ে যদি কোন লোক জিহাদে বের হয় এবং এ দুটির কোনটি নিয়েই আর ফিরে না আসে তার কথা ভিন্ন। অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যেসব আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সর্বোত্তম মর্যাদা লাভ করা যায় জিলহজ মাসের দশদিনের আমল তার অনুরূপ’।
৪। এই দশ দিনে সকল মৌলিক ইবাদত একত্রিত হয়: এই দশদিন আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত প্রায় সকল ইবাদত একত্রিত হয়, যা অন্য কোন সময়ে একত্রিত হওয়া সম্ভব নয়। যেমন হজ, কুরবানী, সালাত, সিয়াম, দান-সাদাক্বাসহ সকল ইবাদত এই দশ দিন একত্রিত করা যায়। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘এ কথা স্পষ্ট হয় যে, জিলহজের প্রথম দশ দিনের বিশেষ গুরুত্বের কারণ; যেহেতু ঐ দিনগুলিতে মৌলিক ইবাদতসমূহ একত্রিত হয়েছে। যেমন সালাত, সিয়াম, সাদাক্বাহ এবং হজ, যা অন্যান্য দিনগুলিতে এভাবে একত্রিত হয় না’।
৫। দ্বীনের নিদর্শনসমূহের সম্মানের সময়: এই দশ দিনে যেহেতু ইসলামের মৌলিক ইবাদত একত্রিত হয়, সেহেতু আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শন সমূহও সম্মান করা সহজ হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এটাই হল আল্লাহর বিধান, যে আল্লাহর নিদর্শন সমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাক্বওয়া থেকেই’ (হজ ২২/৩২)।
আল্লাহর শি‘আর বা নিদর্শন বলতে বুঝায় এমন প্রতিটি বিষয় যাতে আল্লাহর কোন নির্দেশের চিহ্ন দেয়া আছে (কুরতুবী)। এগুলি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের চিহ্ন। বিশেষ করে হজের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াদি, যেমন হজের যাবতীয় কর্মকাণ্ড (কুরতুবী; সাদী)। হাদীর জন্য হাজীদের সঙ্গে নেয়া উট ইত্যাদি (ইবনে কাছীর)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এখানে আল্লাহর নিদর্শন সম্মান করার দ্বারা হাদীর জন্তুটি মোটাতাজা ও সুন্দর হওয়া বোঝানো হয়েছে (ইবনে কাছীর)।
আরাফার দিনের ফজিলত
জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হল আরাফার দিন। এ দিনেরও বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
১। আল্লাহর দ্বীন ও নেয়ামত পরিপূর্ণ হওয়ার দিন: মহানবী (সা.)-এর নবুঅতের শেষদিকে বিদায় হজের সময় আরাফার দিন শুক্রবার আল্লাহ ইসলামকে পরিপূর্ণ দ্বীন হিসাবে ঘোষণা করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)।
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জনৈক ইহূদী তাকে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনাদের কিতাবে একটি আয়াত আছে, যা আপনারা পাঠ করে থাকেন। তা যদি আমাদের ইহুদী জাতির উপর অবতীর্ণ হত, তবে অবশ্যই আমরা সে দিনকে ঈদের দিন হিসাবে পালন করতাম। তিনি বললেন, কোন আয়াত? সে বলল, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। ওমর (রাঃ) বললেন, এটি যে দিনে এবং যে স্থানে নবী করীম (ছাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল তা আমরা জানি। তিনি সেদিন আরাফায় দাঁড়িয়েছিলেন আর সেটা ছিল জুম‘আর দিন’।
২। কুরআন ও হাদীসকে চূড়ান্ত সংবিধান ঘোষণার দিন: রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুর অল্প কিছু দিন আগে বিদায় হজের ভাষণে ক্বিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত আগত সকল মানুষের সকল সমস্যার সমাধান হিসাবে একমাত্র কুরআন ও হাদীসের কথা ঘোষণা করেন। ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে এমন একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধরো, তবে তোমরা আমার মৃত্যুর পর কখনো বিপথগামী হবে না, তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব’।
মালিক ইবনু আনাস (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা সে দুটি জিনিস আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত’।
৩। আল্লাহ এই দিনের কসম করেছেন: আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল-ইয়াউমুল মাও‘ঊদ’ (বুরূজ ৮৫/২) অর্থ-ক্বিয়ামতের দিন; ‘আল-ইয়াউমুল মাশ্হূদ’ (হূদ ১১/১০৩) অর্থ আরাফাতে (উপস্থিতির) দিন এবং ‘আশ্-শাহিদ’ (বুরূজ ৮৫/৩) অর্থ- জুম‘আর দিন’। আল্লাহ বলেন, ‘শপথ জোড় ও বেজোড়ের’ (ফজর ৮৯/৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বেজোড়-এর অর্থ আরাফা দিবস এবং জোড়-এর অর্থ ইয়াওমুন্নাহর (কুরবানী দিন)’।
৪। আরাফাত ময়দানের সন্নিকটে আল্লাহ মানব জাতি থেকে ওয়াদা নিয়েছেন: ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা আরাফার ময়দানের সন্নিকটে না‘মান নামক স্থানে আদম (আঃ)-এর মেরুদন্ড হতে তার সন্তানদের বের করে শপথ নিয়েছিলেন। তাদেরকে পিঁপড়ার মত আদম (আঃ)-এর সামনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ্ তাদের সম্মুখে কথা বলেছিলেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নই? আদম সন্তানরা উত্তর দিয়েছিল, হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি আমাদের প্রতিপালক। এতে আমি সাক্ষী থাকলাম। যাতে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন এ কথা বলতে না পার, আমরা জানতাম না কিংবা তোমরা এ কথাও বলতে না পার, আমাদের পিতৃ-পুরুষগণ আমাদের পূর্বে মুশরিক হয়ে গিয়েছিল। আর আমরা তাদের পরবর্তী বংশধর। তুমি কি বাতিলধর্মী (পিতৃ-পুরুষ)-গণ যা করেছে সে আমলের কারণে আমাদেরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে দিবে’ (আ‘রাফ ৭/১৭২-১৭৩)।
৫। এই দিন সবচেয়ে বেশী মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়: আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এমন কোন দিন নেই, যেদিন আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে আরাফার দিনের চেয়ে জাহান্নাম থেকে বেশি মুক্তি দিয়ে থাকেন। তিনি সেদিন বান্দাদের খুব নিকটবর্তী হন, তাদেরকে নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, এরা কি চায়? (অর্থাৎ তারা যা চায় আমি তাই দেব)।
৬। এই দিন আল্লাহ ফেরেশতাদের কাছে তার বান্দাদের নিয়ে গর্ব করেন: নবী করীম (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা আরাফার দিন বিকেলে আরাফায় অবস্থানকারী ব্যক্তিদের নিয়ে ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করেন। অতঃপর বলেন, তোমরা আমার বান্দাদের দিকে লক্ষ্য কর, তারা আমার কাছে এসেছে মাথায় এলোমেলো চুল নিয়ে ধুলি মলিন অবস্থায়’।
৭। এই দিন মুসলমান (হাজী) দের ঈদ: এই মর্যাদাপূর্ণ দিন প্রত্যেক বছর মুসলমানদের মাঝে ফিরে আসে। এই দিন হাজীগণ আরাফার ময়দানে উপস্থিত হন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমাদের মুসলিম জনগণের ঈদের দিন হচ্ছে আরাফার দিন, কুরবানীর দিন ও তাশ্রীকের দিন। এ দিনগুলি হচ্ছে পানাহারের দিন’।
৮। আরাফার দো‘আ সবচেয়ে উত্তম দো‘আ: নবী করীম (সা.) বলেন, ‘সকল দো‘আর শ্রেষ্ঠ দো‘আ হল আরাফার দিনের দো‘আ। আর শ্রেষ্ঠ কালিমাহ (জিকর) যা আমি পাঠ করেছি ও আমার পূর্ববর্তী নবীগণ পাঠ করেছেন তা হল, ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়াহদাহূ লা- শারীকা লাহূ লাহুল মুলকু, ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুওয়া ‘আলা- কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর’। অর্থ- আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই। তিনি অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শারীক নেই। তাঁরই রাজত্ব। তার জন্যই সকল প্রশংসা। তিনি সব কিছুর উপরে ক্ষমতাবান’।
৯। এই দিনের সিয়াম দুই বছরের গুনাহের কাফফারা: কাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আরাফা দিবসের সিয়াম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আরাফা দিবসের সিয়াম সম্পর্কে আল্লাহর কাছে আমি আশা করি যে, তা বিগত এক বছর ও আগত এক বছরের গোনাহের কাফফারা হবে’। সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আরাফার দিন সিয়াম রাখে তার পরপর দুই বৎসরের পাপরাশি মাফ হয়ে যায়’।
১০। হজের মূল কাজ হল আরাফায় অবস্থান করা: হজের অন্যতম ফরজ হল আরাফায় ময়দানে অবস্থান করা। সুতরাং ‘যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বেই আরাফায় পৌঁছে গেল সে হজ পেয়ে গেল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ফজরের পূর্বে আরাফায় অবস্থান করল না, তার হজ বিনষ্ট হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘হজ হচ্ছে আরাফায় অবস্থান, হজ হচ্ছে আরাফায় অবস্থান, হজ হচ্ছে আরাফায় অবস্থান। মিনার জন্য নির্ধারিত আছে তিন দিন। কোন ব্যক্তি যদি দুই দিন থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসে, তবে তার কোন গুনাহ হবে না। আর যদি কোন ব্যক্তি বিলম্ব করে, তারও কোন গুনাহ হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২০৩)। ফজর উদয়ের পূর্বেই যে ব্যক্তি আরাফায় পৌঁছে যায়, সে হজ পেয়ে গেল’
কুরবানীর দিনের ফজিলত
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের শেষ দিন হল ইয়ামুন নাহার বা কুরবানীর দিন। এই দিনের বিশেষ ফজিলত ও গুরুত্ব রয়েছে। যেমন-
১। এটা হজের বড় দিন: ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) (জিলহজের ১০ তারিখ) নাহরের দিন তিনটি জামরার মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, এটি কোন দিন? লোকেরা বলল, আজ কুরবানীর দিন। তিনি বললেন, আজ হজের বড় দিন’।
২। এটি আল্লাহর নিকট মহান দিন: নবী করীম (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই কুরবানীর দিন আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মহান দিন। অতঃপর ‘ক্বার্র’-এর দিন। ছাওর বলেন, তা কুরবানীর দ্বিতীয় দিন’।
উল্লেখ্য যে, অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে এই দশক উত্তম নাকি রমজানের শেষ দশক উত্তম। এই প্রশ্নের জবাবে ইবনু তায়মিয়া (৬৬১-৭২৮ হিঃ) (রহঃ) বলেন, ‘জিলহজের প্রথম দশকের দিনগুলি রমজানের শেষ দশকের দিনগুলি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আর রমজানের শেষ দশকের রাতগুলি জিলহজের প্রথম দশকের রাতগুলি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’।
ইবনু তাইমিয়া (রহঃ)-এর উক্তি প্রসঙ্গে ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘এ উত্তর নিয়ে যদি কোন যোগ্য ও জ্ঞানী ব্যক্তি গভীরভাবে চিন্তা করেন, তাহলে তা সন্তোষজনক ও যথেষ্টরূপে পাবেন। যেহেতু দশ দিন ছাড়া অন্য কোন দিন নেই যার মধ্যে কৃত নেক আমল আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় হতে পারে। তাছাড়া এতে রয়েছে আরাফার দিন, কুরবানী ও তারবিয়া (৮ই জিলহজের) দিন। পক্ষান্তরে রমজানের শেষ দশকের রাত্রিগুলি হল জাগরণের রাত্রি। যে রাত্রিগুলিতে রাসূল (সা.) রাত জেগে ইবাদত করতেন। আর তাতে রয়েছে এমন একটি রাত, যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’।
৩। কুরবানি করা: কুরবানি বলা হয় ঈদুল আযহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের লক্ষে যবেহ করা। ইসলামি শরিয়তে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কোরআন, হাদিস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত্য দ্বারা প্রমাণিত। কোরআন মজীদে যেমন এসেছে—
‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও (পশু) নাহর (কুরবানি) কর।’
‘বল, আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোনো শরিক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’
হাদিসে এসেছে- বারা ইবনে আযিব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ঈদের সালাতের পর কুরবানির পশু যবেহ করল তার কুরবানি পরিপূর্ণ হল ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল।
আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে দুটি সাদা কালো বর্ণের দুম্বা কুরবানি করেছেন। তিনি বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর বলেছেন। তিনি পা দিয়ে দুটো কাঁধের পাশ চেপে রাখেন। তবে বুখারিতে ‘সাদা-কালো’ শব্দের পূর্বে ‘শিং ওয়ালা’ কথাটি উল্লেখ আছে।
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আমল
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আমলগুলিকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ আম বা সাধারণ ইবাদত। অর্থাৎ জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন বছরের অন্যান্য দিনের ন্যায় সকল নেক আমল করা। যেমন সালাত, সিয়াম, দান-সাদাক্বাহ, তাসবীহ-তাহলীল, রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরূদ পাঠ, পাপ থেকে তওবা করা, কারো হক নষ্ট হলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া ইত্যাদি। পাশাপাশি মুনকার বা নিষিদ্ধ কাজ করা থেকে বিরত থাকা।
দ্বিতীয়ত: খাছ বা বিশেষ ইবাদত। জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের কিছু বিশেষ আমল রয়েছে। যেমন-
১। হজ পালন করা: সামর্থ্যবান সকল মুসলিমের উপর হজ ফরয (আলে ইমরান ৩/৯৭)। হজ পালনের জন্য প্রস্তুতিমূলক কয়েকটি মাস থাকলেও একমাত্র হজের কার্যক্রম সম্পাদন করা হয় জিলহজ মাসে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হজের মাস ছাড়া কারো হজের ইহরাম বাঁধা উচিত নয়’। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘হজের মাসগুলি ছাড়া ইহরাম বাঁধা উচিত নয়। কারণ হজের মাসগুলিতে ইহরাম বাঁধা হজের সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হজ হয় সুনির্দিষ্ট মাসসমূহে। অতএব এই মাসসমূহে যে হজ করা স্থির করে নিল, তার জন্য হজের সময় অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়’ (বাক্বারাহ ২/১৯৭)।
যারা হজ পালন করবেন তাদের জন্য এই মাসে নিন্মের কাজগুলি ধারাবাহিকভাবে করতে হবে।
ক) ইহরাম বাঁধা ও ওমরা পালন: হজ ও ওমরার প্রথম কাজ হল সঠিক নিয়মে ইহরাম বাঁধা। বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে যে কোন হজ বা ওমরাকারী যখনই মক্কায় প্রবেশ করবেন তখনই মীকাত হতে ইহরাম বাঁধবেন। হজের মাস সমূহের মধ্যে যদি কোন মুসলিম হজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন তাহলে প্রথমে ওমরার জন্য ইহরাম বেঁধে মক্কায় প্রবেশ করে ওমরাহ আদায় করে তামাত্তু‘ হজ পালনকারীগণ হালাল হয়ে যাবেন। আর ক্বিরান হজ পালনকারীগণ ইহরামসহ থাকবেন এবং ৮ই জিলহজের জন্য অপেক্ষা করবেন। এ সময় তারা কা‘বা ঘর তাওয়াফ, বায়তুল্লায় সালাত আদায়, বেশী বেশী দো‘আ, জিকর, তাসবীহ-তাহলীল ও অন্যান্য ভাল কাজ করতে থাকবেন।
খ) ৮ই জিলহজের আমল: ৮ই জিলহজ থেকেই মূলতঃ হজের কার্যক্রম শুরু হয়। এই দিন তামাত্তু‘ হজ পালনকারীগণ হজের নিয়তে ওযূ-গোসল করে সুগন্ধি মেখে ইহরাম বেঁধে তালবিয়াহ পাঠ করতে করতে নিজ অবাসস্থল থেকে কা‘বা ঘরের ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। সকল হজ পালনকারীগণ যোহরের পূর্বে মিনায় পৌঁছে সেখানে রাত্রিযাপন করবেন ও পাঁচ ওয়াক্ত সালাত তথা যোহর, আছর, মাগরিব ও এশা যথা সময়ে ক্বছর করে জমা না করে শুধু ফরয সালাত আদায় করবেন। তবে ফজরের দুই রাক‘আত সুন্নাত, বিতর সালাত ও সম্ভব হলে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করবে।
গ) ৯ই জিলহজের আমল: এই দিন হজ পালনকারীগণ সূর্য উদয়ের পর তালবিয়া পাঠ করতে করতে মিনা থেকে ১৪.৪ কিলোমিটার দূরে আরাফা ময়দানের দিকে রওয়ানা হবেন। আর সেখানে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত অবস্থান করবেন এবং যোহরের সময় এক আযানে দুই ইক্বামতে যোহর ও আছর সালাত ক্বছর ও জমা করে আদায় করবেন। সূর্যাস্তের পর হজ পালনকারীগণ আরাফার ময়দানে মাগরিব সালাত আদায় না করে ৯ কিলোমিটার দূরে মুযদালিফার দিকে রওয়ানা হবেন ও সেখানে মাগরিব ও এশার সালাত জমা ও ক্বছর করে আদায় করবেন এবং রাত্রিযাপন করবেন।
ঘ) ১০ই জিলহজের আমল: এই দিন সকালে মুদালিফায় ফজরের সালাত আদায় করে ৫ কিলোমিটার দূরে মিনার দিকে রওয়ানা হবেন এবং বড় জামারাতে ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। কঙ্কর নিক্ষেপের পর তালবিয়া পাঠ বন্ধ করবেন এবং স্ত্রী সহবাস ব্যতীত প্রাথমিকভাবে হালাল হয়ে যাবেন। তারপর কুরবানী করবেন এবং পুরুষরা মাথা মুন্ডন করবেন। আর মহিলাগণ চুলের আগা থেকে একটু ছেটে ফেলবেন। তারপর ফরয তাওয়াফ বা তাওয়াফে ইফাযা ও ছাফা-মারওয়ায় সাঈ করে পূর্ণ হালাল হয়ে যাবেন এবং মিনায় গিয়ে রাত্রিযাপন করবেন।
ঙ) ১১, ১২ ও ১৩ই জিলহজের আমল: এই তিন দিন হজ পালনকারীগণ মিনায় অবস্থান করবেন এবং সূর্য ঢলে যাওয়ার পর তিন জামারায় আল্লাহু আকবার বলে ৭টি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন।
২। ঈদের সালাত আদায় করা: এই দশ দিনের অন্যতম আমল হল ঈদুল আযহার সালাত আদায় করা। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহে যেতেন এবং সেখানে তিনি প্রথম যে কাজ করতেন তা হল সালাত আদায়। আর সালাত শেষ করে তিনি লোকদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন এবং তাঁরা কাতারে বসে থাকতেন। তিনি তাঁদের নসীহত করতেন, উপদেশ দিতেন এবং নির্দেশ দান করতেন। যদি তিনি কোন সেনাদল পাঠাবার ইচ্ছা করতেন, তবে তাদের আলাদা করে নিতেন। অথবা যদি কোন বিষয়ে নির্দেশ জারী করার ইচ্ছা করতেন তবে তা জারী করতেন। অতঃপর তিনি ফিরে যেতেন’।
উল্লেখ্য, মহিলারাও ঈদের সালাতে পুরুষদের সাথে পর্দা সহকারে গমন করে সালাত আদায় করবেন। এমনকি ঋতুবর্তীরাও ঈদগাহে যাবেন এবং দো‘আয় অংশগ্রহণ করবেন তথা খুৎবা শ্রবণ করবেন।
৩। কুরবানী করা: জিলহজ মাসের প্রথম দশকের বিশেষ আরেকটি আমল হল কুরবানী করা। পৃথিবীর প্রত্যেক মুসলমান চাই সে হজ পালনকারী হন বা হজের বাইরে থাকুন সকলেই এই দিনে কুরবানী করে আল্লাহর আদেশ পালন করেন। হজে তামাত্তু‘ ও হজে ক্বিরানকারীগণ মিনা ও তার আশপাশ হারাম এলাকায় আর হজের বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মুসলমানরা তাদের স্ব স্ব অবস্থানস্থলে কুরবানী করেন। কুরবানীর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমার রবের জন্য সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’ (কাওছার ১০৮/২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে’। তবে কুরবানী করা ওয়াজিব নয় বরং সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। লোকেরা যাতে এটাকে ওয়াজিব মনে না করে, সেজন্য সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আবুবকর ছিদ্দীক, ওমর ফারূক, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস, বেলাল, আবূ মাসঊদ আনছারী (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীগণ কখনো কখনো কুরবানী করতেন না। প্রত্যেক পরিবারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক বছর একটি পশু দ্বারা কুরবানী করাই যখেষ্ট। তবে তাক্বওয়া সহকারে (হজ ২২/৩৭) যে যত বেশী করবে তার তত সওয়াব হবে।
জিলহজ মাসের রোজা (সিয়াম)
৪। সিয়াম (রোজা) পালন করা: জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের বিশেষ আমল হল রোজা পালন করা। নবী করীম (সা.)-এর কোন স্ত্রী থেকে বর্ণিত যে, ‘রাসূলুল্লাহ্ (সা.) জিলহজ মাসের নয় দিন, আশুরার দিন এবং প্রত্যেক মাসের তিন দিন, মাসের দুই সোমবার এবং বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করতেন’। জিলহজ মাসের প্রথম নয় দিন সিয়াম পালন করার গুরুত্ব থাকলেও আরাফাতের দিন সিয়াম পালনের আলাদা ফজিলত রয়েছেন। আর তা হল বিগত ও আগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আরাফার দিন সিয়াম রাখে তার পরপর দুই বৎসরের পাপরাশি মাফ হয়ে যায়’।
৫। জিকির করা: এই দশ দিনের অন্যতম আমল হল আল্লাহর বেশী বেশী জিকির করা তথা তাকবীর, তাহমীদ ও তাহলীল পাঠ করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যেন তারা নিজেদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাজির হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুস্পদ জন্তু থেকে যে রিযিক দিয়েছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে’ (হজ ২২/২৮)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এই দিনসমূহ আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাপূর্ণ এবং এই দশদিনের মধ্যে সম্পাদিত আমল আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। সুতরাং এই দিনগুলিতে তোমরা বেশী বেশী তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদ পাঠ কর’।
যারা হজে থাকবে তাদেরকেও আল্লাহ এই দিনগুলিতে জিকিরের নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে আরাফার ময়দান থেকে ফিরে আসার পর। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং যখন তোমরা আরাফাত হতে ফিরে আসবে, তখন মাশ‘আরুল হারামের কাছে পৌঁছে আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং তিনি যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন ঠিক সেভাবে তাঁকে স্মরণ করবে’ (বাক্বারাহ ২/১৯৮)। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হজের অবস্থা সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে সকালে মিনা থেকে আরাফার দিকে রওয়ানা হই। তখন আমাদের মধ্যে কেউ তালবিয়া পাঠ করেছেন এবং কেউ তাকবীর পাঠ করেছেন’।
হজের কাজ শেষ করার পর আল্লাহকে স্মরণ করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন তোমরা হজের অনুষ্ঠানাদি সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহকে এভাবে স্মরণ করবে যেভাবে তোমরা তোমাদের পিতৃ পুরুষদের স্মরণ করে থাক, অথবা তারচেয়েও অধিক’ (বাক্বারাহ ২/২০০)।
৬। তাকবীর পাঠ করা: তাকবীর তথা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করা এই দিনগুলির অন্যতম আমল। তাকবীর পাঠের সময়সীমা দুই ধরনের হতে পারে।
প্রথমত: আম বা ব্যাপাক তাকবীর: জিলহজ মাসের প্রথম তারিখ থেকে তের তারিখ পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করা। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা গণনাকৃত দিনগুলিতে আল্লাহকে স্মরণ করবে’ (বাক্বারাহ ২/২০৩)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, (বাক্বারাহ ২/২০৩) দ্বারা (জিলহজ মাসের) দশ দিন বুঝায় এবং দ্বারা ‘আইয়ামুত-তাশরীক’ বুঝায়। ইবনু ওমর ও আবূ হুরায়রা (রাঃ) এই দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের দিকে যেতেন এবং তাদের তাকবীরের সঙ্গে অন্যরাও তাকবীর বলত। মুহাম্মাদ ইবনু আলী (রহঃ) নফল সালাতের পরেও তাকবীর বলতেন।
দ্বিতীয়ত: নির্দিষ্ট দিনে তাকবীর: জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আছর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয সালাতের শেষ তাকবীর বলবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) আরাফার দিন ফজর থেকে কুরবানীর দিন আছর পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। তাকবীরের শব্দাবলী নিন্মরূপ-
বাংলা উচ্চারণ: ‘আল্লাহু আক্বার আল্লাহু আক্বার লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু আকবার আল্লাহু আক্বার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। হাজীগণ ইহরাম বাঁধার পর তাকবীর দিবেন। তবে হজের দিনগুলি তথা ৮-১২ ই জিলহজ বেশী বেশী নিম্নোক্ত তালবিয়া পাঠ করবেন।
‘আমি হাজির হে আল্লাহ, আমি হাজির। আমি হাজির। তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, অনুগ্রহ ও সাম্রাজ্য সবই তোমার; তোমার কোন শরীক নেই’। এই দিনগুলিতে তাকবীর উচ্চস্বরে পাঠ করবেন।
৭। চুল ও নখ কর্তন না করা: জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আরেকটি আমল হল জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী পর্যন্ত চুল ও নখ কর্তন না করা। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা রাখলে, জিলহজ মাসের প্রথম দশক শুরু হয়ে গেলে সে যেন নিজের চুল ও চামড়ার কোন কিছু স্পর্শ না করে (না কাটে)। অন্য এক বর্ণনায় আছে, সে যেন কেশ না ধরে ও নখ না কাটে। অপর এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি জিলহজ মাসের নব চাঁদ দেখবে ও কুরবানী করার নিয়ত করবে, সে যেন নিজের চুল ও নিজের নখগুলি না কাটে। ঈদের সালাতের পর কুরবানী করে নখ ও চুল কাটতে পারবে। রাসূল (সা.) বলেন, যার কুরবানীর পশু রয়েছে, সে যেন জিলহজ মাসের নতুন চাঁদ উঠার পর থেকে কুরবানী করার পূর্ব পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।
কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তি যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইখলাসের সাথে এ আমল করে তাহলে ঐ ব্যক্তি কুরবানীর পূর্ণ সওয়াব পাবে। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা কুরবানীর দিনকে এ উম্মতের জন্য ঈদ হিসাবে পরিগণিত করেছেন। এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমি যদি দুগ্ধবতী ছাগল ছাড়া অন্য কোন পশু না পাই তবে কি তা দিয়েই কুরবানী করব? তিনি বললেন, ‘না, তবে তুমি এ দিন তোমার চুল ও নখ কাটবে। তোমার গোঁফ কাটবে। নাভির নিচের পশম কাটবে। এটাই আল্লাহর নিকট তোমার পরিপূর্ণ কুরবানী’।
জিলহজের প্রথম দশ দিনগুলোতে যেসব আমল করা মুস্তাহাব
১। তাওবা: তাওবা অর্থ ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানি থেকে ফিরে আসা, আল্লাহর হুকুমের পাবন্দি করার উপর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা এবং অতীতের কৃত কর্মের উপর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তা ছেড়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে আর কখনো আল্লাহর নাফরমানি না করা ও তার হুকুমের অবাধ্য না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা। এ দিনগুলোতে তাওবা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে মোমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর— বিশুদ্ধ তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সে দিন আল্লাহ লজ্জা দেবেন না নবীকে এবং তার মোমিন সঙ্গীদেরকে, তাদের জ্যোতি তাদের সম্মুখে ও দক্ষিণ পার্শ্বে ধাবিত হবে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর, নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’
২। ফরয ও নফল সালাতগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করা: অর্থাৎ ফরয ও ওয়াজিবসমূহ সময়মত সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নত, মুস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। ফরয সালাতগুলো সময় মত সম্পাদন করা, বেশি বেশি করে নফল সালাত আদায় করা। যেহেতু এগুলোই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার সর্বোত্তম মাধ্যম। সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: তুমি বেশি বেশি সেজদা কর, কারণ তুমি এমন যে কোনো সেজদাই কর না কেন তার কারণে আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমার গুনাহ ক্ষমা করবেন। [মুসলিম] এটা সব সময়রে জন্য প্রযোজ্য। নিয়মিত ফরয ও ওয়াজিবসমূহ আদায়ে যত্নবান হওয়া- অর্থাৎ, ফরয ও ওয়াজিবসমূহ সময়-মত সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সকল ইবাদতসমূহ তার সুন্নত, মোস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা।
হাদিসে এসেছে— আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো অলির সঙ্গে শত্রুতা রাখে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা ফরয ইবাদতের চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয় কোনো ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই, আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে কোনো কিছু চাইলে আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায় আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেই। আমি যে কোনো কাজ করতে চাইলে তাতে কোনো রকম দ্বিধা করি না, যতটা দ্বিধা করি মুমিন বান্দার প্রাণ হরণে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে থাকে অথচ আমি তার প্রতি কষ্টদায়ক বস্তু দিতে অপছন্দ করি।’
৩। সিয়াম পালন-রোজা রাখা: জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের রোজা রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। যেহেতু অন্যান্য নেক আমলের মধ্যে সিয়ামও অন্যতম, তাই এ দিনগুলোতে খুব যত্নসহকারে সিয়াম পালন করা। হাফসা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো চারটি আমল পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হল: আশুরার সওম, জিলহজের দশ দিনের সওম, প্রত্যেক মাসে তিন দিনের সওম, ও ফযরের পূর্বের দুই রাকাত সালাত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোজা রাখবে, একদিনের রোজার বিনিময় তার চেহারাকে জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর খারিফ দূরে রাখবে”।
৪। হজ ও ওমরা করা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। এ দুটি ইবাদতে রয়েছে পাপের কুফল থেকে আত্মার পবিত্রতা, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হতে পারে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করেছে, তাতে কোনো অশ্লীল আচরণ করেনি ও কোনো পাপে লিপ্ত হয়নি সে সে দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে গেল, যে দিন তার মাতা তাকে প্রসব করেছে।’
হাদিসে আরও এসেছে, আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহকে তার মধ্যবর্তী পাপসমূহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আর কলুষযুক্ত হজের পুরস্কার হল জান্নাত।’
৫। আল্লাহর জিকির করা: এ দিনসমূহে অন্যান্য আমলের মাঝে জিকিরের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, যেমন হাদিসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: এ দশ দিনে [নেক] আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে অধিক প্রিয় ও মহান আর কোনো আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল [লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ] তাকবীর [আল্লাহু আকবার] তাহমীদ [আল-হামদুলিল্লাহ] বেশি করে আদায় কর। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’
অধিকাংশ আলেম বলেছেন- এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিন বলতে জিলহজের প্রথম দশ দিনকে নির্দেশ করা হয়েছে। এ সময়ে আল্লাহর বান্দাগণ বেশি বেশি করে আল্লাহর প্রশংসা করেন, তার পবিত্রতা বর্ণনা করেন, তার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেন, কুরবানির পশু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম ও তাকবীর উচ্চারণ করে থাকেন।
হাদিসে আছে চারটি বাক্য আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। ১-সুবহানাল্লাহ, ২-আলহামদু লিল্লাহ, ৩-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ৪-আল্লাহু আকবর। এ দিনগুলোতে এ জিকিরগুলো করা যেতে পারে।
৬। তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ: এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজারসহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা হবে। তবে মেয়েরা নিম্ন-স্বরে তাকবীর পাঠ করবে।
সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবু হুরাইরা রা. জিলহজ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও তাকবীর পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবীর পাঠ করতেন। অর্থাৎ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই দুই প্রিয় সাহাবি লোকজনকে তাকবীর পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।
ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ইবনে ওমর ও আবূহুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের জন্য বের হতেন, মানুষরাও তাদের দেখে দেখে তাকবীর বলত। তিনি আরও বলেছেন, ইবনে ওমর মিনায় তার তাবুতে তাকবীর বলতেন, মসজিদের লোকেরা শুনত, অতঃপর তারা তাকবীর বলত এবং বাজারের লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীর বলত। এক পর্যায়ে পুরো মিনা তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত।
ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ দিনগুলোতে মিনায় তাকবীর বলতেন, প্রত্যেক সালাতের পর, বিছানায়, তাঁবুতে মজলিসে ও চলার পথে সশব্দে তাকবীর বলা মোস্তাহাব। যেহেতু ওমর, ইবনে ওমর ও আবূহুরায়রা সশব্দে তাকবীর বলেছেন।
৭। আরাফার দিন রোজা রাখা: হজ পালনকারী ছাড়া অন্যদের জন্য আরাফার দিন রোজা রাখা। আবু কাতাদাহ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরাফার দিনের রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, ইহা পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছররে গুনাহর কাফফারা হবে।
৮। কুরবানির দিন তথা দশ তারিখের আমল-
কুরবানির দিনের ফজিলত: এ দিনের একটি নাম হল ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। যে দিনে হাজীগণ তাদের পশু যবেহ করে হজকে পূর্ণ করেন। হাদিসে এসেছে— ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানির দিন জিজ্ঞেস করলেন এটা কোনো দিন? সাহাবিগণ উত্তর দিলেন এটা ইয়াওমুন্নাহার বা কুরবানির দিন। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: এটা হল ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। [আবু দাউদ: ১৯৪৫, আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।]
[২] কুরবানির দিনটি হল বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। হাদিসে এসেছে—
আব্দুল্লাহ ইবনে কুরত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহর নিকট দিবসসমূহের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হল কুরবানির দিন, তারপর পরবর্তী তিনদিন।
এ দিনগুলোর ব্যাপারে অনেক মুসলিমই গাফেল, অথচ অনেক আলেমের মতে নিঃর্শতভাবে এ দিনগুলো উত্তম, এমনকি আরাফার দিন থেকেও। ইবনুল কাইয়্যেম রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন: আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম দিন, নহরের দিন। আর তাই হল হজ্জে আকবারের দিন। যেমন সুনানে আবূ দাউদে রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় দিন হল নহরের দিন, অতঃপর মিনায় অবস্থানের দিন। অর্থাৎ এগারতম দিন। কেউ কেউ বলেছেন: আরাফার দিন তার থেকে উত্তম।
কারণ, সে দিনের সিয়াম দুই বছরের গুনাহের কাফফারা। আল্লাহ আরাফার দিন যে পরিমাণ লোক জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন, তা অন্য কোনো দিন করেন না। আরও এ জন্যও যে, আল্লাহ তা‘আলা সে দিন বান্দার নিকটবর্তী হন এবং আরাফায় অবস্থানকারীদের নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন। তবে প্রথম বক্তব্যই সঠিক: কারণ, হাদিস তারই প্রমাণ বহন করে, এর বিরোধী কিছু নেই। যাই হোক, উত্তম হয় আরাফার দিন নতুবা মিনার দিন, হাজী বা বাড়িতে অবস্থানকারী সবার উচিৎ সে দিনের ফজিলত অর্জন করা এবং তার মুহুর্তগুলো থেকে উপকৃত হওয়া।
উক্ত আমলগুলি সম্পাদনের মাধ্যমে জিলহজ মাসের ফজিলত লাভ করা যায় এবং অশেষ সওয়াব হাসিল করা যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে উক্ত আমলগুলি সঠিকভাবে পালন করে পরিপূর্ণ সওয়াব লাভের তাওফীক দান করুন। আমিন। -সংগৃহীত।
বিএনএনিউজ/বিএম,জিএন