বিএনএ, চট্টগ্রাম: শুল্ক বৃদ্ধির কারণে নতুন করে আরও এক দফা বেড়েছে আমদানি করা ফলের দাম। দেশের অন্যতম বৃহত্তম ফলের পাইকারি আড়ত চট্টগ্রাম নগরীর ফলমন্ডিতে দাম বাড়ায় প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। এমনিতেই বছরব্যাপী ঊর্ধ্বমুখী থাকা এসব ফলে আবারও শুল্ক বাড়ায় বর্তমানে রীতিমতো নাগালের বাইরে চলে গেছে দাম। আপেল, মাল্টা, কমলা, আঙুর, নাশপাতিসহ সব ধরনের ফলে কেজিপ্রতি বেড়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। এদিকে শুল্ক হ্রাসের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে ফল ব্যবসায়ীরা।গতকাল রোববার ফলমন্ডির সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ফলজাতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহারের আলটিমেটাম দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যথায় আমদানি ফল খালাস বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে আজ ঢাকায় বাংলাদেশ ফ্রেশ ফুডস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। সেখানে সারা দেশের আমদানিকাররা বৈঠক করে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করবেন।
গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শুকনো ও টাটকা ফল আমদানির ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এতে মাল্টা, আপেল, আঙুর, নাশপাতি ও তরমুজের মতো কিছু টাটকা ফল ও জুসের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। শুল্ক বাড়ানোর পর থেকেই বাজারে দামে উত্তাপ ছড়িয়েছে। রমজানের আগে এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন ক্রেতারা। বিক্রেতারাও বলছেন, নতুন করে ধার্য্য করা শুল্ক হ্রাস বা বাতিল করা না হলে দাম বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে না।
আমদানিকারকরা জানান, সারা দেশে ১ হাজার ৫০০ আমদানিকারক বিদেশ থেকে ফলমুল আমদানি করেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের আমদানিকারক রয়েছেন ৪০০। শুল্ককর বাড়ানোর কারণে আমদানিকারক পাইকার ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন।
চট্টগ্রাম নগরীর বৃহত্তম আড়ত ফলমন্ডিতে গত এক সপ্তাহ ধরে সব ধরনের ফলের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে আপেল পাইকারিতে মানভেদে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা। প্রতি কেজিতে শুল্ক বেড়েছে ১২০ টাকা পর্যন্ত। মাল্টা প্রতি কেজি ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা, আঙুর সাড়ে ৬ কেজির এক কার্টন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকা। প্রতি কেজিতে দাম পড়েছে ৪৬০ থেকে ৪৭০ টাকা। মান্ডারিন (ছোট আকারের কমলা) প্রতি কেজি ৩০০ টাকা, নাশপাতি প্রতি কেজি ৩০০ টাকা। তবে খেজুরের শুল্ক প্রত্যাহার করায় দাম স্থিতিশীল ছিল। তাও মানভেদে প্রতি কেজি খেজুর ৭০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। অন্যদিকে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মাল্টা মানভেদে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি আপেল ২৫০ থেকে ২৯০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বৃহত্তম ফলের আড়ত কোতোয়ালি থানাধীন কদমতলী এলাকার ফলমন্ডি। এই আড়ত থেকে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় খুচরা ব্যবসায়ীরা মণপ্রতি ফলের কার্টন কিনে নিয়ে যান। ফলমন্ডির ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ তৌহিদুল আলম বলেন, বাজারে এখন সব ধরনের ফলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ৯ জানুয়ারি সরকার শুল্ককর বৃদ্ধির কারণেই ফলের দাম বেড়েছে। আমদানিকারক পাইকার ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই আমরা শুল্কর কমানোর জন্য এখন রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়েছি। আজ (রোববার) আমরা ফলমন্ডির সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছি। সোমবার ঢাকায় গিয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বৈঠক করা হবে। এরপর আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
তিনি বলেন, আমদানি ফলের প্রতিটি আইটেমের গড় হিসাব করলে ১৩৬ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ককর বেড়েছে। যা অনেক বেশি। আমরা ফল নিয়ে সিন্ডিকেট করতে পারি না। কারণ এসব পচনশীল দ্রব্য। সময়মতো বিক্রি না করলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। দাম বৃদ্ধির কারণে ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই আমদানি ফলের ওপর দেশে কয়েক লাখ ভাসমান ব্যবসায়ী ভ্যান গাড়িতে, ফুটপাথে ফল বিক্রির ব্যবসা করেন। ক্রেতা না পেলে তারা বেকার হয়ে পড়বে।
আমদানিকারকরা বলেন, রমজানকে সামনে রেখে এনবিআরের কাছে তাদের দাবি ছিল যাতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, আমদানি শুল্ক ও অগ্রিম কর সবমিলিয়ে ৩০ শতাংশ কর ছাড় দিতে। রমজানে আমদানি ফলের চাহিদা থাকে বেশি তাই এসব ফলে শুল্কছাড়ের প্রস্তাব রাখা হয়। এতে আমদানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকার পাশাপাশি বাজারে দাম নাগালে থাকত। কিন্তু সরকার উল্টো শুল্ক আরও বাড়িয়েছে। এখন বাড়তি শুল্ক হ্রাস না করলে দাম বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা আসন্ন রমজান পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, বিদেশি ফলকে ২০১২ সালে বিলাস পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপর জাতীয় বাজেটে আমদানি ফলের ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত আমদানি করা সব ধরনের ফলে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ৪ শতাংশ অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট ছিল। এরপর ২০২৪ সালের মে মাসে সব ধরনের বিদেশি ফল আমদানিতে নতুন করে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়। এরপর ফল আমদানিতে শুল্ক কর বেড়ে দাঁড়ায় ১১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। বছর না গড়াতেই ৯ জানুয়ারি শুল্ক ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়।
ছয় মাসে ফল আমদানি : বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় ৩৮ ধরনের ফল। এর মধ্যে আপেল, মাল্টা, কমলা, আঙুর, আনার, খেজুর, নাশপাতি বেশি আমদানি হয়। এ ছাড়াও বছরজুড়ে আরও নানা ধরনের ফল আমদানি করা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আপেল আমদানি হয়েছে ৫১ হাজার ৬৯ টন, মাল্টাসহ কমলাজাতীয় পণ্য ৬২ হাজার ৭৪৭ টন ও আঙুর আমদানি হয়েছে ১৭ হাজার ৩৬৫ টন। এ সময় খেজুর আমদানি হয়েছে ৫৩ হাজার ৬৪৯ টন। চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি ফল আনা হয় বিশেষায়িত রিফার কনটেইনারে। ৪০ ফুট দীর্ঘ এসব কনটেইনারগুলো একেকটি রেফ্রিজারেটর। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে রাখতে হয়। রিফার কনটেইনার থেকে পণ্য খালাসে দেরি হলে আমদানি পণ্যে দাম বেড়ে যায়। যত দেরি হবে তত রেন্ট বা বন্দর ভাড়া বাড়বে। আবার রিফার কনটেইনার ভর্তি ফলমুল দীর্ঘ সময় খালাস ছাড়া পড়ে থাকলে আমদানিতে সংকট দেখা দেয়। শিপিং এজেন্টরা পচনশীল পণ্য আমদানি করার মতো রিফার কনটেইনারের জোগান নিশ্চিত করতে পারে না।
ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ : এদিকে আমদানি ফলসহ ফলজাতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহারের দাবিতে চট্টগ্রামে মানববন্ধন করেছে ফল আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারি বিক্রেতারা। রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর কদমতলী এলাকায় ফলমন্ডির সামনে মানববন্ধন করে চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতি। মানববন্ধনে ফলজাতীয় পণ্যের অতিরিক্ত রাজস্ব প্রত্যাহারে এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। অন্যথায় আরও বড় পরিসরে আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগে সমিতির সভাপতি হাজি আলী হোসেনের সভাপতিত্বে আয়োজিত মানববন্ধনে সমিতির কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পাইকার ব্যবসায়ীরা অংশ নেন। এতে ব্যবসায়ীরা বলেন, অতিরিক্ত শুল্ক কর আরোপ করায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ৯ জানুয়ারি ফল পণ্যের ওপর অতিরিক্ত এসডি, টিটিআই ১৭ দশমিক ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি করে এসআরও জারির পর ফলের দাম বাড়ছে।
আগে থেকেই ফল ব্যবসায়ীরা ক্ষতির শিকার হয়ে আসছিলেন জানিয়ে বলা হয়, ডলার সংকটসহ নানা বাধার মুখে ফলের ব্যবসা। এর মধ্যে ফল পণ্যে অতিরিক্ত ভ্যাট, এসডি ও টিটিআই বসানোর কারণে ফল ব্যবসায়ে ধস নামবে। সরকার আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে অতিরিক্ত শুল্ক এসডি, টিটিআই প্রত্যাহার না করলে সারা দেশের ব্যবসায়ীরা এনবিআর কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেবে। প্রয়োজনে সারা দেশের ফল আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের সব স্থলবন্দর থেকে আমদানি করা ফল এবং ফলপণ্য খালাস বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বিএনএনিউজ/ নাবিদ