বিএনএ, ঢাকা : ৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই, রোমের সম্রাট নিরো, ইতালির অ্যানজিও শহরে ছুটি কাটানোর সময় রোমে আগুন লাগে। যা ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট ফায়ার অব রোম’ নামে পরিচিতি পায়। মিথ আছে, রোম যখন জ্বলছিল, তখন নিরো বাঁশি বাজাচ্ছলেন! এক সপ্তাহ পর যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, ততক্ষণে রোমের ১৪টি জেলার ১০টি পুরোপুরি ভষ্ম হয়ে যায়। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় ৫-১০ লাখ মানুষ।

২০২৫ সালের জুলাইতে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের যুদ্ধাবস্থা পরিস্থিতিকে, নিরোর বাঁশি বাজানোর সঙ্গে তুলনা করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
গত ১৬ জুলাই অর্ন্তবর্তীকাল সরকারের পৃষ্টপোষকতায় গড়ে উঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি তথা এনসিপির লং মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ নিয়ে লঙ্কাকান্ড ঘটে যায়। এনসিপি নেতারা সেনাবাহিনীর এপিসিতে লুকিয়ে খুলনায় পৌঁছায়। এর আগে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় ৫জন। তাদের ময়না তদন্ত ছাড়া দাফন করতে বাধ্য করা হয়। জারি করা হয়, কয়েক দফায় কারফিউ। পাড়ায় পাড়ায় অভিযান চালিয়ে অন্তত: ১৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার অভিযোগে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের তিন হাজার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়। বিপরীতে নিহতদের পক্ষে একটি মামলাও দায়ের হয়নি।
বাংলাদেশ থেকে যখন গোপালগঞ্জ বিছিন্ন এবং সেখানকার জনগণ অবরুদ্ধ; তখনই খবর এলো বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের মিশন চালু হতে যাচ্ছে। তিন বছর মেয়াদি মিশন চালুর জন্য সমঝোতা স্মারক সই করেছে দুই পক্ষ। পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়াম বাংলাদেশের এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার–বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক জাতিসংঘের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে সই করেছেন। জেনেভা থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার–বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর, শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান জানিপপ-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ।
গত বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক ঢাকা সফর করেন। তার সঙ্গে বৈঠক শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ ঢাকায় ওএইচসিআর এর অফিস খোলার বিষয়ে সরকারের সম্মতির বিষয়টি প্রথম সাংবাদিকদের জানান। সেদিনই হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়।
সংগঠনটির আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব সাজেদুর রহমান সাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, “ঢাকায় তাদের অফিস খুলতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চরম আত্মঘাতী হবে। নতুন করে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি হোক এবং তাতে অন্তর্বর্তী সরকার আরও দুর্বল হয়ে পড়ুক, তা আমরা চাই না।”
হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মহিবুল্লাহ বাবুনগরী ৫ জুলাই ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস, খুলতে দেয়া হবে না। অতীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘মানবাধিকারের’ নামে ইসলামি শরিয়াহ, পারিবারিক আইন ও ধর্মীয় মূল্যবোধে হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা করেছে দাবি করে তিনি বলেন, “এসব হস্তক্ষেপ একদিকে যেমন জাতীয় সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত, অন্যদিকে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় অনুভূতিরও পরিপন্থী।”
হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী বলেছেন, জাতিসংঘ ঢাকায় অফিস করলে সমকামিতা উৎসাহিত হবে। তাহলে তো সভ্যতা থাকবে না। তারা কাদিয়ানি, সংখ্যালঘু, পাহাড়ি, নানা ইস্যু তৈরি করবে। খ্রিস্টানদের প্রভাব বেড়ে যাবে। আর নারী স্বাধীনতার নামে তারা নারীদের, ইসলামের বিধিবিধানের বাইরে নিয়ে যেতে কাজ করবে।
ইসলামী আন্দোলনও এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউর রহমান গাজী বলেন, “এখানে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি আছেন। আলাদা করে আর মানবাধিকার কমিশনের অফিস দরকার আছে বলে মনে করি না। আর এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনা তা বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ঘটেছে। তার বিচার প্রক্রিয়া চলছে। ফলে মানবাধিকার কমিশনের অফিস আর দরকার নাই।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি – সিপিবি বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপনের বিরোধী। তবে তাদের বিরোধিতার কারণ ভিন্ন। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “কোনো একটি দেশ যদি দীর্ঘ মেয়াদে সংকটে পড়ে যায়, তাহলে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন অফিসের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তো এমন কোনো দীর্ঘ মেয়াদী সংকটে পড়ে নাই যে তাদের অফিস লাগবে।”
বিএনপি এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো অবস্থান না জানালেও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এমন সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চান।
এই ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামী এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। অন্যদিকে ঢাকায় জাতিসংঘ অফিস স্থাপনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জুলাই আন্দোলন পরবর্তীতে আশা করা হয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি নতুন গণতান্ত্রিক দেশ গড়ে তুলবে। কিন্তু নানা ইস্যুতে, দেশের মানুষ তথা রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং মবোক্রেসির বিস্তার দেশকে ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী তিন বছরও নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিএনএনিউজ/সৈয়দ সাকিব/এইচ.এম।