বিএনএ, চট্টগ্রাম: বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় হাসিনা সরকারের। এর পর পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। অন্তবর্তীকালীন সরকার অনুপস্থিত জনপ্রতিনিধির পরিষদে উপস্থিতি নিয়ে কঠোর হোন সরকার। সরকারের এমন প্রদক্ষেপে উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় চেয়ারম্যানরা পরিষদে আসতে চাইলেও বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে বলে জানান এসব চেয়ারম্যানরা। এদিকে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভোট চুরি, বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় নানা প্রহসনের মাধ্যমে নির্বাচন জনপ্রতিনিধিদের অবিলম্বে পদত্যাগ ও অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণসহ বিভিন্ন দাবিতে মিছিল ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে ছাত্রজনতা।
সোমবার (১৮ আগস্ট) চট্টগ্রামের বেশ কিছু উপজেলায় এসব চেয়ারম্যানদের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্রজনতা বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি প্রদান করে নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে।
এর মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের, কর্ণফুলী উপজেলা, লোহাগড়া উপজেলা, উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় চেয়ারম্যানদের পদত্যাগের দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
এর মধ্যে লোহাগড়া উপজেলার বটতলী মোটরস্টেশন থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে শেষ হয়।
ছাত্রজনতার দেয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়, পলাতক হাসিনার অবৈধ নির্বাচনে নির্বাচিত সকল জনপ্রতিনিধির পদত্যাগ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের গাড়িসহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ সরকারি দপ্তরে ফেরত দেয়া এবং এসব জনপ্রতিনিধিদের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
জবাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইনামুল হাছান বলেন, ছাত্রজনতার দাবির প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান এর গাড়ি নিয়ে ফেলা হয়েছে এবং উপজেলার প্রশাসনিক দায়িত্ব নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে চলে এসেছে।
এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা যদি কার্যলয়ে না আসেন, তাহলে ওখানে উপজেলা প্রশাসন থেকে একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত বড়হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিজয় কুমার বড়ুয়াসহ কয়েকজন খুব শিগগিরই পদত্যাগ করবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।
এ দিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে কর্ণফুলী উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয় ছাত্রজনতা। এবিষয়ে জানতে চাইলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী
মোঃ ইবরাহীম খলিলুল্লাহ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্রআন্দোলনে নিউমার্কেটস্থ সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর অতর্কিত হামলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং তাদের ইন্ধন দাতা৷, উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুককে কর্ণফুলির পবিত্র মাটিতে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চাইনা আমরা।
এছাড়াও ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে যেসবগুলো নির্বাচন হয়েছে সবগুলো রাতের আঁধারের নির্বাচন। রাতের আঁধারের নির্বাচনের চেয়ারম্যানকে উপজেলা পরিষদ থেকে পদত্যাগ চাই। ফ্যাসিস্ট নির্বাচনের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সকল ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা পরিষদে কোনো প্রকার কার্যসস্পাদন করতে পারবে না। আমরা ইউএনও মহোদয়কে অবগত করছি তিনি ব্যবস্থা নিবেন বলে জানিয়েছেন। আমরা এ বিষয়ে কাল স্মারকলিপি দিব। এ বিষয়ে কথা বলতে ইউএনও মাসুমা জান্নাতকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
একই দাবিতে উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ও ২ মেয়র ও চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে তালা ঝু্লিয়ে অবস্থান কর্মসূচি করে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী ও ছাত্রজনতা। ফটিকছড়িতে বিগত নির্বাচনে নৌকা নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের দাবীতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিক্ষুব্ধ জনতা ।
রোববার (১৮ আগস্ট) সকাল ৭ টা থেকে উপজেলা পরিষদ, ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট পৌরসভাসহ সুয়াবিল, সুন্দরপুর, কাঞ্চন নগর, দাঁতমারা, নারায়ণহাট,বাগান বাজার ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে তালা ঝুঁলিয়ে দিয়ে অবস্থান কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রবিবার সকাল থেকে ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের গেইটের সামনে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণে দাবীতে বিক্ষোভ করেন। এছাড়াও ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট পৌরসভার প্রধান গেইটে তালা ঝুঁলিয়ে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে সুয়াবিল, সুন্দরপুর, দাঁতমারা, নারায়ণহাট ও কাঞ্চন নগর ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে তালা ঝুঁলিয়ে দিয়ে অবস্থান কর্মসূচিসহ বিক্ষোভ সমাবেশ করেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনসহ জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা।
এসময় নেতা-কর্মীরা শেখ হাসিনার অধিনে অনুষ্টিত বিগত নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার দাবি জানান।
জানা যায়, দুপুর ১২ টার দিকে উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শারমীন আক্তার নুপুর পরিষদে প্রবেশ করতে চাইলে উপজেলা মহিলা দলের নেতা-কর্মীরা তাকে বাধা প্রদান করে। এসময় তার সাথে ধস্তাধস্তি হয় বলে সুত্র জানায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শারমিন নুপুর বলেন, ‘আমি কোনো লোভে পরে উপজেলা পরিষদে যাইনি। আমি আমার অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেছি। তারা আমাকে বাধা দিয়েছে। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই।’
জানা গেছে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নাজিমুদ্দিন মুহুরী, ফটিকছড়ি পৌর মেয়র মো.ইসমাঈল হোসেন ও নাজিরহাট পৌর মেয়র একে জাহেদ চৌধুরী, সুয়াবিলের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, সুন্দরপুরের মুহাম্মদ শাহনেওয়াজ, নারায়ণহাটের চেয়ারম্যান আবু জাফর মাহমুদ, দাঁতমারার জানে আলম ও কাঞ্চন নগরের দিদারুল আলম, বাগান বাজার ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সাজু আজ (রবিবার) অফিস করতে পারেনি।
এ দিকে উপজেলার পরিষদ, দুই পৌরসভাসহ ৬ টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা কার্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কারণে সেখানে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাগণকে জম্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউপি চেয়ারম্যান মো. নোয়াব আলীকে গণধোলাই দিয়েছে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। তিনি আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের অনুসারি বলে পরিচিত।
রোববার (১৮ আগষ্ট) সাড়ে দশটার দিকে বৈরাগ ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে এ গণধোলাইয়ের ঘটনা ঘটে। এসময় তার সাথে থাকা আরো দুজনকে দালাল দালাল বলে চড়থাপ্পড় মারেন জনতা। গণধোলাইয়ের শিকার বৈরাগ ইউপি চেয়ারম্যান নোয়াব আলীকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।
চন্দনাইশে চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবীতে মানববন্ধন হয়েছে। চন্দনাইশে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সহযোগী আওয়ামী যুবলীগ, ছাত্রলীগ কতৃক হামলাকারীদের অর্থের যোগানদাতা চন্দনাইশ উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ও হাসিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট খোরশেদ বিন ইসহাক’র পদত্যাগের দাবিতে দক্ষিণ জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ শাহা’র নেতৃত্বে মানববন্ধন করেছে বৈষম্য বিরোধী প্রতিবাদী ছাত্র জনতা ও এলাকাবাসী।
গত ১৮ আগষ্ট দুপুরে হাশিমপুর ইউনিয়ন পরিষদে তার পদত্যাগ ও অপসারণের দাবীতে এই মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় বৈষম্য বিরোধী প্রতিবাদী ছাত্র জনতার নেতাকর্মী ও এলাকাবাসীরা ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থান নিয়ে চেয়ারম্যান এডভোকেট খোরশেদ বিন ইসহাকের বিরুদ্ধে নানান অনিয়ম,চাঁদাবাজির কথা তুলে ধরে বিভিন্ন স্লোগান দেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতারা জানান, আওয়ামিলীগের নেতাদের সহযোগিতায় রাতের ভোটে অবৈধভাবে খোরশেদ বিন ইছাহাক হাশিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছেন। এরপর থেকেই সে বিচার বাণিজ্য, সার্টিফিকেট বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে আসছে। তাই এই অবৈধ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হাশিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খোরশেদ বিন ইছাহাকের পদত্যাগ ও অপসারণের দাবীতে আজকের মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
একই দাবিতে বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া, পুঁইছড়ি, শেখেরখীল, চাম্বল, শীলকূপ, কাথরিয়া, সরল, কালীপুর, বৈলছড়ি, খানখানাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণ ও দুর্নীতি মুক্ত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে এলাকাবাসী। একই সাথে বাঁশখালী পৌরসভার মেয়র, পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এস এম তোফাইল বিন হোছাইন এর অপসারণ চেয়ে সকাল থেকে এলাকাবাসীর অবস্থান ও বিক্ষোভ সমাবেশ দেখা গেছে।
রোববার (১৮ আগস্ট) সকাল থেকেই বাঁশখালী পৌরসভা সহ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় এলাকাবাসী বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে ইউনিয়ন পরিষদ ঘেরাও করে অবস্থান কর্মসূচী পালন করে। দ্রুত অপসারণ চেয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে প্রশাসক নিয়োগের দাবীতে বিক্ষুদ্ধজনতা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করেন এবং বিভিন্ন স্লোগান দেন।
এ বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেসমিন আক্তার জানান, আজকে কয়েকজন চেয়ারম্যান অফিসে এসেছেন। বাঁশখালীর সবকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারনের দাবীর প্রেক্ষিতে ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচির বিষয়ে অবগত হয়েছি। এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএনএনিউজ/নাবিদ, ওজি/এইচমুন্নী