।। এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন।।
বিএনএ, কক্সবাজার : তীব্র গরমে সারাদেশ ওষ্ঠাগত। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু লবণ উৎপাদনে। গরমের তীব্রতা বাড়লে বাড়ে লবণ উৎপাদন। গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে লবণ উৎপাদনে অভ্যস্ত লবণ চাষীরা। সারা দেশের মানুষ অসহ্য তাপদাহ থেকে বাঁচতে যখন বৃষ্টির অপেক্ষায় প্রার্থনা করে, ঠিক তখনই হচ্ছে লবণ উৎপাদনের জন্য আদর্শ সময়।
টানা কয়েক দিনের দাবদাহে পর্যাপ্ত লবণ উৎপাদন হয়েছে। তীব্র গরমে বিভিন্ন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হলেও দৈনিক লবণ উৎপাদন হচ্ছে অন্যসময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ কক্সবাজার জেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে দৈনিক রেকর্ড ৩৫/৪০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এতে মহাখুশি উপকূলের ৪৫ থেকে ৫০ হাজার প্রান্তিক লবণচাষি।
চাষিরা বলছেন, পুরো বৈশাখ মাস এমন অবস্থা বিরাজ করলে লবণের বাম্পার ফলন হবে। চলতি মৌসুমে বিগত চার মাসে উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ মেট্রিক টনের কিছু বেশী । সব মিলিয়ে চলতি মাস পর্যন্ত সাড়ে ২৩ লাখ মেট্রিক টন লবণের বার্ষিক চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। অবশ্য চাষীরা বলছেন এর মধ্যে প্রাকৃতিক দূর্যোগ, সাইক্লোন, কালবৈশাখীর তাণ্ডব কিংবা ঝড়-বৃষ্টি হলে লবণ উৎপাদন ব্যাহত হবে। এক দিন বৃষ্টি হলে প্রায় এক সপ্তাহ লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে। তখন সাড়ে ২৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ৫ মাস) কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এসব জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ২৩ লাখ মেট্রিক টন।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে একাধিক নিম্নচাপ ও একটি ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। তখন লবণ চাষের মারাত্মক ক্ষতি হবে।
কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল, চৌফলদণ্ডী, পিএমখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হাজার হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন চলছে। চাষিরা মাঠের ওপর কালো ত্রিপল বিছিয়ে সমুদ্রের লোনাপানি জমিয়ে রাখছেন। তপ্ত রোদে শুকিয়ে সেই লোনাপানি লবণে পরিণত হচ্ছে। কিছু চাষি মাঠে উৎপাদিত লবণ গর্তে ঢুকিয়ে (মজুত) রাখছেন। কেউ কেউ বস্তায় ভরে লবণ বাড়ির আঙিনায় স্তূপ করে রাখছেন। কেউ গুদামে মজুত করছেন।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, গত মৌসুমে এ সময়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ৩০ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছিল। এবার তীব্র দাবদাহের ফলে টানা তিন দিন ধরে দৈনিক ৩৫ /৪০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হচ্ছে, যা মৌসুমের সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন।
গত দুই দিনে টেকনাফ, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর উপজেলার বিভিন্ন উপকূল ঘোরার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে (বিসিক) লবণ প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪১০ থেকে ৪২০ টাকায়। গড়ে ৪০০ টাকা ধরলে দৈনিক উৎপাদিত ৩৫/৪০ হাজার মেট্রিক টন লবণের দাম আসে ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকা।
আগামী ১৫ মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদনের মৌসুম উল্লেখ করে (বিসিক) লবণ শিল্পের উপ মহা ব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূইঁয়া বলেন, প্রতিবছর এপ্রিলের মাঝামাঝিতে কালবৈশাখী, বৃষ্টি দেখা দেয়। এতে সাত-আট দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে। এবারও তেমন পরিস্থিতি বিরাজ করলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বাঁশখালীসহ কক্সবাজার জেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। সম্প্রতি টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের খারাংখালী, হ্নীলার লবণ চাষী সাইফুল ইসলাম,নবী হোসেন কবির আহমদও নুর মোহাম্মদ নামের লবণ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২ এপ্রিলের ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিতে টানা সাত দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল। ১০ এপ্রিল থেকে পুরোদমে লবণ উৎপাদন শুরু হয়। এর আগে ২০ মার্চের ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিতে সাত দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল।
পিএমখালীর চাষি এমডি হাসান (৩৫) বলেন, কয়েক দিন ধরে মাঠে লবণের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এতেও মনে শান্তি নেই। কারণ, আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে একাধিক নিম্নচাপ ও একটি ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। তখন লবণ চাষের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার লেমশিখালী উপকূলে উৎপাদন বাড়লেও লবণের দাম নিয়ে হতাশার কথা শোনা গেল চাষিদের মুখে। খুরুশকুলের চাষি গফুর আলম (৪৫) বলেন, ঝড়-বৃষ্টি হলে লবণ উৎপাদনের খরচ বাড়ে। কিন্তু সে হিসাবে লবণের দাম বাড়ে না। বর্তমানে মাঠে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪১০-৪২০ টকায়। মণপ্রতি লবণ উৎপাদন, শ্রমিক ও পরিবহনের বিপরীতে খরচ যায় ২৮০ টাকার বেশি।
কক্সবাজার লবণ চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও মহেশখালীর লবণচাষি মোস্তফা কামাল চৌধুরী জানান, সিন্ডিকেট করে লবণের দাম একেক সময় একেক রকম নির্ধারণ করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে চাষিরা প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেন ২৫০-৩০০ টাকায়, মার্চে ৩২০-৩৭০ টাকায়, আর এখন ৪১০-৪২০ টাকা। চাষিদের দাবি ছিল, মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম ৫০০ টাকা নির্ধারণ।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লবণ আমদানি বন্ধ রেখে মাঠপর্যায়ে চাষিদের সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় লবণ বেচাবিক্রির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ৫০০ টাকায় লবণ বেচাবিক্রিও হয়েছিল। পরবর্তীকালে সিন্ডিকেট চক্র দাম সর্বনিম্ন ২৫০ টাকায় কমিয়ে আনে।
একিকে মহেশখালী উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ শরীফ বাদশাহ বলেন, দেশের চাহিদার এক তৃতীয়াংশ লবণ মহেশখালীতে উৎপাদিত হয়। অথচ লবণ চাষীরা সবচেয়ে অবহেলিত। মাঠ পর্যায়ে লবণ কৃষিপণ্য হলে ও লবণকে শিল্পপণ্য হিসাবে গণ্য করায় চাষীরা নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কক্সবাজার লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফখরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারের যারা মিল মালিক তারা অধিকাংশই লবণ চাষীও। তাই লবণ চাষী ও মিল মালিকদের স্বার্থ এক এবং অভিন্ন। আমরা চাই চাষীদের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ নূন্যতম প্রতি মণ লবণের মূল্য ৫ শ’ টাকা করার। কারণ দেশের সবচেয়ে পরিশ্রমী লেবার হচ্ছে লবণ উৎপাদন ও পরিবহন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা।
এদিকে ইতিমধ্যে সাড়ে ১৭ লাখ মেঃটন লবণ উৎপাদন হয়েছে। টার্গেট সাড়ে ২৩ লাখ মেঃটন। সময় আছে আরো একমাস। পুরাতন লবণ মজুদ রয়েছে প্রায় ৭ লাখ মেঃটন লবণ। সুতরাং লবণের সংকট দেখিয়ে এক শ্রেণীর লবণ মিল মালিক শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রনালয়কে ভুল তথ্য পরিবেশন করে লবণ আমদানির পাঁয়তারা চালাচ্ছেন, যা লবণ লিল্প মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে এমনটাই জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
বিএনএনিউজ/এইচ.এম।