বিএনএ ডেস্ক : ভূরাজনীতির সঙ্গে যে কোন দেশের অভ্যান্তরীণ রাজনীতি অনেকাংশে জড়িত। তার প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে রিপাবলিক পার্টির ক্ষমতায় ফিরে আসায় বিশ্বরাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন। ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে সখ্যতা না থাকায় ক্ষমতাচ্যূত হয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে সখ্যতার সূত্রেই বাংলাদেশের অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্ঠা হয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফের ক্ষমতায় আসতে পারেনি ডেমোক্রেটিক পার্টি। ফলে অনেকটা চাপে পড়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কেননা সদ্য নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্পের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুসর্ম্পক নেই। বরং বৈরী।
এ দিকে পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের প্রভাবশালী নেতা চিকিৎসক ভরত বড়াই বলেছেন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাবেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনরা। ট্রাম্প আগামী জানুয়ারিতে ক্ষমতায় বসার পর মার্কিন প্রশাসন ও কংগ্রেস যেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়, সে লক্ষ্যে তৎপরতা চালাচ্ছেন তাঁরা।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। ওই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ভরত বড়াইয়ের বিশ্বাস, বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর যে দমন–পীড়ন হয়েছে, তার জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন ট্রাম্প।
ভরত বড়াই বলেন, ‘বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর দমন–পীড়ন ও হিন্দুদের মন্দিরের পবিত্রতা বিনষ্ট করা নিয়ে সাহসী বক্তব্য দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তিনি একজন সাহসী মানুষ। বাংলাদেশে হিন্দুদের পরিস্থিতি যদি ভালো না হয়, তাহলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন তিনি।’
বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন ও মার্কিন কংগ্রেসকে রাজি করাতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনরা যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন ভরত বড়াই। প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ব্যবসার ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক রপ্তানি। এই রপ্তানি যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে বাংলাদেশের মানুষ কী খাবে?’
এ দিকে বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে চরমপন্থার বাড়বাড়ন্ত এবং সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন নিয়ে ফের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করল আমেরিকার হবু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শিবির।
প্রথম দফায় দক্ষিণ এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তা লিসা কার্টিস মন্তব্য করেছেন, শেখ হাসিনাকে উৎখাতের ফলে বাংলাদেশ ‘গুরুত্বপূর্ণ একটি সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, যা তাদের ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করবে’। চরমপন্থী, মৌলবাদী এবং জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে শেখ হাসিনা ‘প্রশংসনীয়’ দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলেও সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন কার্টিস।
বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকার বাইডেন সরকার এবং ট্রাম্পের মধ্যে গুরুতর মতভেদের বিষয়টি আগেও সামনে এসেছে। শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, বাইডেন প্রশাসনই গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়েছে। হাসিনার দাবি অনুযায়ী— সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছেড়ে দিতে রাজি না-হওয়াতেই বাইডেন প্রশাসনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু পরিকল্পনা করে তাঁকে উচ্ছেদ করেছেন।
ট্রাম্পের ঘনিষ্ট হিসাবে পরিচিত লিসা কার্টিস বলেন, “বলা হয়েছিল শেখ হাসিনার উৎখাতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বেশ কিছু জঙ্গি নেতাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের উপরে আক্রমণের ঘটনা ঘটছে।”
২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া সংক্রান্ত ডিরেক্টরের দায়িত্বে থাকা কার্টিস বলেন, “বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার ইতিহাস আছে। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে হামলা ভয়ঙ্কর ঘটনা। এ দেশে আইএস প্রভাবিত কিছু শক্তি রয়েছে। হাসিনা জঙ্গি শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে প্রশংসনীয় কাজ করেছিলেন। রাজনীতির ময়দানে এই শক্তির ফিরে আসার বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগের।যদিও এটা অগ্রাধিকারের প্রথম স্থানে নেই, তবু ভাবী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা দল বাংলাদেশকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে।”
ড. ইউনূসের আরেক গলার কাটা সাবেক কংগ্রেসওম্যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল টুলসী গ্যাবার্ড। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাশানাল সিকিউরিটি এজেন্সির ডিরেক্টর হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক হিসেবে ১৮টি গুপ্তচর সংস্থার নেতৃত্ব দেবেন এবং ৭৬ বিলিয়ন ডলারের বাজেট তদারকি করবেন। কট্টর হিন্দু টুলসী গ্যাবার্ড ন্যাশানাল সিকিউরিটি এজেন্সির ডিরেক্টর হওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে অন্তর্বতীকালীন সরকার।
এদিকে সদ্য নিয়োগ পাওয়া উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও সেখ বশিরকে অপসারণের দাবি জানিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলনসহ বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন। এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে ড. ইউনূস সরকারের অতি ঘনিষ্টতা ও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যূত করা, দলীয় নেতাকর্মীদের গণ মামলায় গ্রেফতার, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন, জেল থেকে জঙ্গীদের ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় ভারত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অভিনন্দনও জানায়নি। ফলে ঘরে-বাইরে স্বস্তিতে নেই ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সৈয়দ সাকিব