বিএনএ, ঢাকা: আবু সাঈদ। বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে। তাঁর বাবা মকবুল হোসেনের বয়স প্রায় ১০০ বছর। মা মনোয়ারা বেগমের বয়স ৯০ বছরের মতো দুই জনই অসুস্থ। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি নির্বাক স্তব্ধ হয়ে গেছেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান আবু সাঈদের বাবা একসময় দিনমজুরি করতেন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে আবু সাঈদ সবার ছোট। একমাত্র তিনিই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার ঘটনা তাঁদের পরিবারে আনন্দের উপলক্ষ হয়ে এসেছিল। তাঁকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন পরিবারের সবাই। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল তাঁদের জীবনে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সারাদেশে ৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে আবু সাঈদের মৃত্যু ব্যতিক্রম। আবু সাঈদ কী জানতেন? তাকে কোটা আন্দোলনে জীবন দিতে হবে? সেকারণে কী সাঈদ ৫৫ বছর আগে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক শামসুজ্জোহাকে স্বরণ করে ছিলেন? এমন প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সারা দেশে। শিক্ষক শামসুজ্জোহা ও ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু যেন একই প্রেক্ষাপটে গাঁথা। পার্থক্য শুধু একজন শিক্ষক, অন্যজন ছাত্র।
অগ্নিঝরা গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোয় যখন পাকিস্তানি শাসকের গুলিতে প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরছিল স্বাধীনতাকামী ছাত্রদের বুক থেকে, তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক শামসুজ্জোহা ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এক শিক্ষক সভায় বলেছিলেন, ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।’ ঠিক তার পরদিনই বিক্ষুব্ধ ক্যাম্পাসে ছাত্র মিছিলের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বুক পেতে নিয়েছিলেন ঘাতকের তপ্ত বুলেট। আর অংশ হয়ে গেলেন ইতিহাসের।
অধ্যাপক শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার ৫৫ বছর পর তাঁর আত্মনিবেদনের সেই বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের ফেসবুক পাতায় পোস্ট দিয়েছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বাদশ ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তিনি লিখেছেন, ‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার, স্যার!
আবেগঘন সেই পোস্টে আবু সাঈদ আরও লিখেছেন ‘আপনার সমসাময়িক সময়ে যাঁরা ছিলেন, সবাই তো মরে গেছেন, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত।
‘এ প্রজন্মে যাঁরা আছেন, আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যত দিন বেঁচে আছেন, মেরুদণ্ড নিয়ে বাঁচুন। ন্যায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। প্রকৃত সম্মান ও শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেঁচে থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে।
‘অন্তত একজন শামসুজ্জোহা হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।’ কী আশ্চর্য! আবু সাঈদও তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের পরদিনই আত্ম–উৎসর্গ করলেন বুকে বুলেটের আঘাত নিয়ে।
সারা দেশে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্রণী ভূমিকা ছিল আবু সাঈদের। সেখানে তিনি ছিলেন এই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। মঙ্গলবার বেলা দুইটার দিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পুলিশ তাদের বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে পুলিশের ছোঁড়া রাবার বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবু সাঈদ। হাসপাতালে আনার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে আবু সাঈদের এই মৃত্যু ৫৫ বছর আগে স্বাধীনতার পুলিশের গুলিতে নিহত শিক্ষক শুধু শামসুজ্জোহাকে স্বরণ করিয়ে দিয়েছে তাই নয়- ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগ এবং গণতন্ত্রের দাবিতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সচিবালয় অবরোধের ডাক দিয়েছিল বিরোধীদলগুলো। অবরুদ্ধ নগরীতে সেদিন রাস্তায় নেমেছিল এক তরুণ, নূর হোসেন। তার বুকে পিঠে স্বৈরতন্ত্রের পতন আর গণতন্ত্রের দাবিতে লেখা শ্লোগান। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগে তোলা নূর হোসেনের ছবি পরবর্তীকালে হয়ে উঠে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
এক শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত পরিবারের এই তরুণ কী ভেবে সেদিন নিজের শরীরকে জীবন্ত পোস্টার করে তুলেছিলেন? ২৭ বছর পর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদ যেন গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক শ্রমজীবী নুর হোসেন এবং ৫৫ বছর আগে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক শিক্ষক শামসুজ্জোহারই উত্তরসূরি।
বিএনএনিউজ/ সৈয়দ সাকিব/ বিএম/এইচমুন্নী