।।মিজানুর রহমান মজুমদার।।
‘খোকা’। এ শব্দটি শুনলে যে কারো মনে হতে পারে কোনো শিশুর কথাই বলা হচ্ছে। ঠিকই শুনেছেন। আজ এমন একজন খোকা কথা বলবো যে শিশু খোকা জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন ১৯২০ সালের এই দিনে (১৭ ই মার্চ) ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেয়া সেই শিশু ‘খোকা’ হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। বিশ্ব মানবতার প্রতিচ্ছবি।
শিশুকালে ‘খোকা’ নামে পরিচিত সেই শিশুটি পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ ও জনগণের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধের কারণেই পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। ইতিহাসের কিংবদন্তি, মহানায়ক। বাঙ্গালি জাতির স্থপতি। তিনি হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু কেবল বাঙালি জাতির নন, তিনি বিশ্বে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের স্বাধীনতার প্রতীক, মুক্তির দূত।শেখ মুজিবুর রহমান কিশোর বয়সেই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে প্রথমবার কারাবরণ করেন। ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিণত হন।
অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তিনি আমৃত্যু লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। নিশ্চিত ফাঁসি যেনে বলেছিলেন, ‘আমি বাঙ্গালি, বাংলা আমার ভাষা। বাংলার মানুষকে আমি ভালবাসি’। বাংলা, বাঙ্গালি শব্দগুলোকে তিনি জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন!
তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার লেখা বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে নিজের লেখা ডায়েরি যা ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামে গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কারাগারের তার সামনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সময়ের খন্ডচিত্র তুলে ধরলেও তার জীবনের অতীত গুলোও প্রসঙ্গক্রমে তুলে ধরেছেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’ নাম রাখেন।
(‘এক সময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।… একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনও কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই।… জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’)। কারাগারের রোজনামচা’য় ২৭৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার উদ্ধৃতি রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার পরদিন মওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর ওই নামকরণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন। এতে প্রমাণিত হয়, বঙ্গবন্ধু শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। চিন্তা চেনতায় ছিলেন দার্শনিক। তিনি আজ দেখতেন, অন্যরা দেখতো পরের দিন। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে চিন্তা করতেন না, সারা পৃথিবীর নিপিড়িত নির্যাতিত মানুষের কথা ভাবতেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায়, ১৯৭৩ সালের জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের বক্তব্যে।
বিশ্বের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের পিছনে ফেলে সেদিন বলেছিলেন, জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম আজও অব্যাহত ভিয়েতনাম, এঙ্গোলা, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, গিনি বিসাওসহ ল্যাটিন আমেরিকা ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাই একটি বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়তে আমাদের সবাইকে এক হয়ে শোষিতের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।
‘উপমহাদেশকে শান্তিপূর্ণ রাখতে হলে, যেকোন সমস্যার মানবিক সমাধান খুঁজতে হবে। একটি সম্মৃদ্ধ বিশ্বের জন্য আমাদের পরমাণু নিরস্ত্রিকরণের ওপর জোর দিতে হবে। আজকের অশান্ত বিশ্বপরিস্থিতি বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আচঁ করছে পেরেছিলেন!
কিন্তু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে যখন অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত করছিলেন, তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে সপরিবারে নিহত হন তিনি। বাঙ্গালি জাতির জন্য এটি লজ্জাজনক নয়, আত্মহত্যার শামিল!
সব ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার আর্দশকে ধারণ করে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করার প্রাণপণ চেষ্ঠা করে যাচ্ছেন। যা এখন দৃশ্যমান। তার চৌকষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। তাঁর কর্ম ও আদর্শ চিরকাল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে।’