বিএনএ, ঢাকা, বিশেষ প্রতিনিধি: প্রবাদ আছে ‘বেড়ায় ক্ষেত খায়’। বেড়ায় যখন ক্ষেত খায়, সে ক্ষেত কী রক্ষা করা যায়? চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) এর কোটি কোটি টাকার ভূমি বেদখল হওয়ার প্রেক্ষাপটে শ্রমিক-কর্মচারি-কর্মকর্তাদের মুখে মুখে শুনা যাচ্ছে প্রবাদটি। দখল হওয়া জমি উদ্ধারে দেশের রাষ্ট্রীয় সার কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ভূমি কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা উপ ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। উল্টো, কখনো কখনো সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে! ফলে সারকারখানাটি শ্রমিক-কর্মচারি, কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ-অসন্তোষ বিরাজ করছে।
সূত্র জানায়, চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৮২-৮৩ সালে রাঙ্গাদিয়া, বন্দর, গোবাদিয়া, মাঝের চর এলাকায় ২৫৭ দশমিক ৪৯ একর খাস জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
এছাড়া রাঙ্গাদিয়া, গোবাদিয়া, বৈরাগ, চাতুরি, বন্দর বেলছুরা, চরখিদিরপুর এলাকায় অধিগ্রহণ করা হয় ১৩৭ দশমিক ৯১ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। এসব জমি থেকে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড (কাফকো) প্রতিষ্ঠার জন্য ৩৮ দশমিক ১৯ একর জমি জেলা প্রশাসকের কাছে ফেরত দেয়া হয়। সিইউএফএল’এর অধিগ্রহণ করা ব্যক্তিমালিকাধীন জমির গেজেট প্রকাশ হয়েছে ১৩৫ দশমিক ৩৭৩ একর। এর মধ্যে নামজারি হয়েছে মাত্র ৪৯ দশমিক ৪৪ একর। অবশিষ্ট ৮৫ দশমিক ৭৪১২ একর জমি নাম জারির জন্য আবেদন করা হলেও আমলাতান্ত্রিক জঠিলতা ও সিইউএফএল এর ভূমি কর্মকর্তার গাফেলতির কারণে দীর্ঘ ৪০ বছরেও নামজারি হয়নি।
সিইউএফএল এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, কারখানা নির্মাণের পর দেখা যায়, বরাদ্দ প্রাপ্ত বিভিন্ন দাগের চেয়েও নতুন দাগের ভূমিতে কারখানা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফলে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) এর দখলে আছে ২৫৫ দশমিক ৪০ একর ভুমি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাঙ্গাদিয়া, বন্দর এবং বৈরাগ মৌজার সিইউএফএল এর সাথে কেপিজেড এর ৮ দশমিক ১৫ একর জমি বিরোধ রয়েছে। জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম সিইউএফএল-কে এলএ মামলা নং-১৯/৭৯-৮০ মূলে রাঙ্গাদিয়া বন্দর ও বৈরাগ মৌজায় উল্লেখিত জমি আরএস মূলে বরাদ্দ দেয়া হয়। একই জমি কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) করপোরেশন (বিডি) লিমিটেডকে বিএস মূলে বরাদ্দ দেয়া হয়।
এদিকে সিইউএফএল এর অতিরিক্ত প্রধান রসায়নবিদ ও বিভাগীয় প্রধান (প্রশাসন) মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন সচিব বরাবরে একটি চিটি দেন। গত ৭ জানুয়ারি ২০২১ খ্রীষ্টাব্দে লেখা এ চিটিতে সিইউএফএল’ এর দখলীয় খাস ও ব্যক্তিমালিকানধীন জমির হালনাগাদ তথ্য প্রদান করা হয়। এতে বলা হয়, গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে অতিরিক্তি জেলা প্রশাসন (এল.এ) চট্টগ্রাম এর সাথে কেইপিজেড ও সিইউএফএল এর প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বিরোধপূর্ণ জায়গা নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল.এ) সার্ভেয়ার নিয়োগের মাধ্যমে বিরোধ পূর্ণ জমিটির সীমানা চিহ্নিত করার জন্য এল.এ শাখার দুজন সার্ভেয়ারকে নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশনা মোতাবেক বিরোধর্পূণ মৌজার বিএস ও আর. এস সিট, গেজেট এবং সার্ভে রিপোর্টের কপি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল. এ) চট্টগ্রাম বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসন (এল. এ) চট্টগ্রাম থেকে কোন সিদ্ধান্ত দেয়ার আগেই যুগ যুগ ধরে সিইউএফএল’ র দখলে থাকা ৮ দশমিক ১৫ একর জমি সম্প্রতি সীমানা নেট লাগিয়ে দখলে নিয়েছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ। জানা যায়, এতে সিইউএফএল কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের বাধা দেয়নি। নিয়ম রক্ষার্থে শুধু চিঠি চালাচালির মাধ্যমে দায়িত্ব শেষ করেছে!
অভিযোগ আছে, এ ক্ষেত্রে লেনদেন হয়েছে মোটা অংকের টাকা। বিষয়টি জানাজানি হলে শ্রমিক-কর্মচারি, কর্মকর্তাদের মধ্য ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। শুধু কেইপিজেড-কে নয়- এর আগে সয়া প্রোডাক্টস লিমিটেড বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২ দশমিক ৮৯৪ একর জমি ছেড়ে দিয়েছে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল)।
২০১৩-১৪ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিইউএফএল কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ২ দশমিক ৮৯৪ একর জমি দখল ছেড়ে দিয়ে ৫ কোটি টাকার অধিক ক্ষতি করা হয়েছে। কেন ও কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প কারখানার নিজস্ব সম্পত্তি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ছেড়ে দিয়ে বা ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করা হয়েছে তার দায় নির্ধারণ ও শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়। কিন্তু দায়ি ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। ফলে দিনদিন বেহাত হয়ে যাচ্ছে সিইউএফএল’ এর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি।
কালুরঘাট ওয়াটার ইনটেক স্টেশনে প্রবেশ পথসহ রাস্তার দু’পাশে কোটি কোটি টাকার জমি বেদখল হয়ে গেছে। এসব জমি উদ্ধার কিংবা দখল প্রতিরোধে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। গত মাসে চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লি: এর নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪ শতক জমি দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সিইউএফএল’ এর শ্রমিক কর্মচারি-কর্মকর্তারা আদালতের নির্দেশনা ছাড়া, যাচাই-বাছাই না করে হঠাৎ করে নিজস্ব রাস্তার পাশে চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, চাপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড যে জমিটি বালির বস্তা দিয়ে ভরাট করেছে, সেটি সিইউএফএল’ এর মালিকানাধীন একটি পুকুর। সেখানে ‘চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার এর নিজস্ব সম্পত্তি প্রবেশ নিষেধ’ সাইনবোর্ড রয়েছে। এ সাইনবোর্ডটি অনেক পুরানো। সিইউএফএল’র সাইনবোর্ডটির পিছনে সম্প্রতি ‘চাপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর নিজস্ব রাস্তা’ লেখা সাইনবোর্ডটি লাগানো হয়েছে। যে পুকুরটির ভরাট করে চাপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ প্রবেশপথ তৈরী করেছে, সে পুকুরটি পুরোটাই সিইউএফএল’ এর দখলে ছিল যুগের পর যুগ। কতিপয় সিবিএ নেতা ওই পুকুরে মাছ চাষের জন্য ভাড়া দিয়ে নিজেদের মতো ভাগবাটোয়ারা করে আসছেন।
অভিযোগ আছে, সিইউএফএল ’র বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রহীম ও উপ-ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কাজী আমিনুল হকের যোগসাজসে চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড জমিটি দখল করে নিয়েছে। সিইউএফএল’ এর শ্রমিক কর্মচারি-কর্মকর্তারা আদালতের নির্দেশনা ছাড়া, যাচাই-বাছাই না করে হঠাৎ করে নিজস্ব রাস্তার পাশে চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে জমি ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে নানা গুঞ্জন।
এ ব্যাপারে উপ-ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কাজী আমিনুল হক বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ)কে বলেন, ওই দাগে ১২ শতক জমি রয়েছে, এর মধ্যে ৪ শতক জমি চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজে লিমিটেডের। সেই জমি সিইউএফএল’ থেকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। সিইউএফএল’ এর নিজস্ব রাস্তায় কেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে কাজী আমিনুল হক বলেন, চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজে লিমিটেডের পক্ষে আবেদন করা হয়েছে। হাক্কানী পেপার মিলের প্রবেশপথ যে প্রক্রিয়ায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সে প্রক্রিয়ায় চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড অনুমোদন পেয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাক্কানী পেপার মিলের প্রবেশ পথ সড়ক ও জনপথ থেকে অনুমোদন প্রাপ্ত। সেখানে সিইউএফএল’ এর কোন জমি নেই। চাঁপাই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে কাজী আমিনুল হক এমন মন্তব্য করেছেন বলে সূত্রে প্রকাশ।
সূত্র জানায়, উপ-ব্যবস্থাপক কাজী আনিসুল হক সিইউএফএল-এ কর্মরত থাকাকালে বিভিন্ন জমি বেদখল হওয়া এবং নামজারির ব্যর্থতার অভিযোগে ২০১৬ সালের শেষের দিকে তাকে বদলী করা হয়। সম্প্রতি বিসিআইসি’র চেয়ারম্যান অবসর গ্রহণ করার পর তিনি আবার স্বপদে ফিরে আসেন। সিইউএফএল’র ভূমি রক্ষা তার দায়িত্ব হলেও তিনি তা যথাযথভাবে পালন করছেন না। কালুরঘাট, চাতুরি চৌমূহনী, কাফকো সেন্টার, জাইল্লাঘাটা এলাকায় সিইউএফএল’এর জমিতে নতুন নতুন বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে।
উল্লেখ, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রহীম এক যুগেরও বেশী সময় কালুরঘাট ওয়াটার ইনটেক স্টেশনে সহকারি রসায়নবিদ ও রসায়নবিদ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সময় মাস্টার অপারেটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন বর্তমান উপ ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কাজী আমিনুল হক। দুই জনই এখন সিইউএফএল’র গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়ার পর সিইউএফএল’এর জমি দখলের বিষয়টি সাদা চোখে দেখছেন না বলে জানান শ্রমিক-কর্মচারি ও কর্মকর্তারা। এ নিয়ে তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ- অসন্তোষ রয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ)’র পক্ষে টেলিফোনে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল)’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি জানান, সম্ভবতঃ জমিটি ব্যক্তিমালিকাধীন। ব্যক্তিমালিকাধীন জমিতে সিইউএফএল এর নিজস্ব সম্পত্তি লেখা সাইনবোর্ড কেন? সিইউএফএল এর দখলে থাকা জমিটি ছেড়ে দেয়ার জন্য আদালতের কোন আদেশ আছে কীনা জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রহীম কোন মন্তব্য করেননি।
চলবে—দ্বিতীয় পর্ব
বিএনএ/ ওয়াইএইচ/ এসজিএন