।।সৈয়দ গোলাম নবী।।
শিক্ষকতা মহান ও পবিত্র পেশা। জাতির ও সভ্যতার উন্নয়নের নিবেদিত মানবতার কল্যাণময় মহান এ দায়িত্বটা যাঁরা পালন করেন তাঁরাই শিক্ষক ও সমাজের আলোকিত মানুষ। জন্মের পর সন্তানরা পৃথিবীর আলো দেখতে পায়। কিন্তু জন্মের স্বার্থকতাকে শিক্ষা দানের মাধ্যমে পরিপূর্ণ জীবন দান করেন শিক্ষক। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়, পূজনীয় এ সমাজ দরদী মানুষই শিক্ষক। আমাদের জাতির দূর্ভাগ্য যে- সেই মহান শিক্ষক কে আমরা যথাযথ কদর-মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছি বারে বারে। তেমনি মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত আমাদের চট্টগ্রামের সন্তান ও উপ-মহাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ অন্যতম।
ছৈয়দ ছোলতান ভারতের পশ্চিমবঙ্গস্থ নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আজকের প্রাথমিক শিক্ষা আন্দোলনকে যথাযথ স্বীকৃতি আদায় করে বর্তমান অবস্থানে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেজন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি হাসি-মুখে জেল পর্যন্ত বৃটিশ আমলে বরণ করেছেন। বাঙালীদের শিক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা, শিক্ষা বিস্তারে তৎপর থাকার অপরাধে বৃটিশ বাহিনীর হাতে বারে বারে নির্যাতিত হন। নির্যাতন আর অন্ধকার কারাবরণেও ছৈয়দ ছোলতানকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।
তিনি তাঁর শিক্ষার উন্নয়ন আন্দোলনে ব্রত হয়ে সফলতা লাভ করেছেন। ছৈয়দ ছোলতান একাধারে শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, চিন্তাবিদ, গবেষক ও সাংবাদিকতায় অবদান রেখে সমগ্র ভারতবর্ষে কৃতি মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সম্মত হন। কিন্তু আমরা দূর্ভাগা জাতি যে, এত বড় গুণি মানুষকে জীবিত অবস্থায় মূল্যায়ন তো হয়নি, মৃত্যুর পরও কোন সরকার মূল্যায়ন করতে এগিয়ে আসেননি, বর্তমানে আমরা ভুলে যেতে বসেছি এ প্রয়াত গুণী শিক্ষা দরদীকে।
মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ এর জন্ম ১৯০২ সালের ১৪ এপ্রিল চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া গ্রামের ছৈয়দ বাড়ীতে। তাঁর পিতা ছিলেন তৎকালীন খিলাফত আন্দোলনের একনিষ্ট কর্মী মরহুম আলহাজ্ব মওলানা ছৈয়দ আলিম উল্লাহ্ শাহ্। মায়ের নাম লতিফা খাতুন। ছৈয়দ ছোলতান একদিকে বৃটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের কারাবরণ কারী সৈনিক, অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের সুযোগ-সুবিধা ও দাবী-আদায়ের লক্ষে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন, নিপীড়িত নিগৃহীত ও নির্যাতিত হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি নিরলস পরিশ্রমী সফল সংগঠক ও সমাজসেবী ছিলেন। ১৯২৮ সালে ফেনী মাদ্রাসা থেকে ইংরেজীসহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে মোয়াল্লিম ট্রেনিং পাশ করেন। মওলানা মরিুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মহাকবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর নির্দেশে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ ১৯২৭ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি গঠন করেন ও এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পর থেকে তাঁর চিন্তা শুরু হয় সমগ্র উপমহাদেশের শিকদের কল্যাণের লক্ষ্যে শিক্ষকদের সংগঠিত করার জন্য। ১৯২৮ সালে। কলিকাতায় চলছিল অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের সম্মেলন। তিনি কংগ্রেস সদস্য হিসেবে সম্মেলনে যোগদেন। সম্মেলনের এক ফাকে পূর্ব পরিকল্পনা মত শিক্ষকদের নিয়ে সমাবেশ করেন এবং নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি গঠন করেন। সমাবেশ শেষে সর্ব সম্মতিক্রমে শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক সভাপতি, স্যার আজিজুল হক সহ-সভাপতি ও মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবার তাঁর স্বপ্ন জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের দিকে পা বাড়ায়।
শিক্ষক সমিতির ব্যানারে সংগঠিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে (উপমহাদেশে) শিক্ষক সমাজ নিজেদের সমস্যা, চিহ্নিত ও সমাধানের উপায় নির্ধারণ ও শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ছৈয়দ ছোলতান ১৯২৬ সালে নিজ গ্রামের মনজিলের দরগাহ নামক স্থানে মার্দাশা-সোনাকানিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন ( বর্তমানে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়)। তিনি দীর্ঘদিন এ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদও অলংকৃত করেন।
একদিকে শিক্ষকদের নিয়ে আন্দোলন অন্যদিকে দেশ প্রেমিক রাজনীতিক হওয়ায় বৃটিশ সরকারের কুনজরে ছিলেন তিনি। ১৯৪৪-৪৫ সালে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতার লক্ষে প্রবাসে এক গোপন সরকার গঠিত হয়। মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ ছিলেন ওই গোপন সরকারের মন্ত্রীসভার একজন সদস্য। আবার, আজাদ হিন্দ ফৌজের বিপ্লবী কমিটিরও নেতৃত্ব দেন। এসব কারণে বৃটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে ১৯৪৪ সালে তাঁকে ১০ মাস কলিকাতা ও রংপুরে কারাবরণ করতে হয়।
১৯৫১ ও ১৯৬৪ সালে তিনি দেশব্যাপী শিক্ষক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও জেলা স্কুল বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সম্মেলন আহ্বান করেন। যার উদ্ভোধক ছিলেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক। ১৯৪৮ সাল থেকে ৬০সাল পর্যন্ত সারাদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। তিনি সব অনুষ্ঠান ও সভায় মাতৃভাষার গুরুত্ব ও স্বীকৃতির দাবি তুলতেন। শিক্ষক সমিতির নেতা হওয়ায় সারাদেশ ভ্রমণ করে তার জন্য কাজটি সহজও ছিল।
পরবর্তীতে ও দীর্ঘকাল তাঁকে গৃহথেকে দূরে থাকতে হয়েছে শিক্ষকদের দাবী ও রাজনীতির কারণে। তিনি নিখিল বঙ্গ কংগ্রেস, জমিয়তে ওলামা ও কৃষক প্রজা পার্টির অন্যতম সংগঠক ও নেতা ছিলেন মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান। চট্টগ্রাম কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা, সাতকানিয়া কলেজ, দেওদীঘি হাইস্কুল, মির্জাখীল হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় অংশ নেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমবায় সমিতি, ফকির মাওলানা হাঙ্গর খাল সমবায় সেচ সমিতি, সোনাকানিয়া ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি ও বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) সমাজ কল্যাণ সমিতি গঠন করেন। দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি কল্যাণ সাধন ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। সারাজীবন খদ্দের কাপড় পরিধান করেছেন তিনি। দেশীয় খদ্দর কাপড় ছাড়া কখনও বিদেশী কাপড় পরিধান করতেন না। ১৯৪৬ সালে সংসদ নির্বাচনে বৃহত্তর সাতকানিয়া আসন থেকে মনোনয়ন পত্র পেশ করেন কিন্তু কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেন এবং পটিয়া আসনের প্রার্থী মওলানা মনিরজ্জুমান ইসলামাবাদীর পক্ষে নির্বাচনী কাজে অংশ নেন। ১৯৪৭ সালে তিনি পবিত্র হজ্ব আদায় করেন।
আলহাজ্ব মৌলভী ছৈয়দ ছোলতান আহমদ ৩ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। ১ম পুত্র মরহুম মুফতী ছৈয়দ মোস্তফা কামাল এশিয়া টাঙ্গাইলস্থ মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেক্টর, ২য় পুত্র মরহুম সাংবাদিক ছৈয়দ মোস্তফা জামাল ও ৩য় পুত্র ছৈয়দ মোস্তফা আইয়ুব একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক, রাজনীতিক, সমাজদরদী এই মহামানুষটি ১৯৭০ সালের ১৭ জানুয়ারি সোনাকানিয়া গ্রামের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর পরম ইচ্ছানুসারে তাঁদের পূর্ব পুরুষ হযরত আল্লামা শরফুদ্দীন(র.)কাতালপীরের মনজিলের দরগাহের পাশে তাকে কবর দেয়া হয়।
তাঁর ৫৩তম মৃত্যু বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।মহান আল্লাহতায়ালা তাকে সার্বিক ক্ষমা ও বেহেস্ত নসিব করুন। আমিন।