বিএনএ, ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়ত তাকে ক্ষমতায় চায় না বলেই বাংলাদেশের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশে গত ১৪ বছর ধরে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকায় দেশে অসাধারণ উন্নয়ন হয়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফররত অবস্থায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইয়ালদা হাকিম।
প্রায় আধঘণ্টা ধরে চলা ওই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ, বিচার বর্হিভূত হ্ত্যা, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, গণতন্ত্র এবং রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশে অটোক্রেসি বা একনায়কতন্ত্রের যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করা হয়, সেটি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘গত ১৪ বছর ধরেই শুধুমাত্র দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে, তাই আমরা উন্নতি করতে পারছি।’
বিবিসির ইয়ালদা হাকিমের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলাপচারিতায় দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে।
বিবিসি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র কেন বাংলাদেশের একটি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন?
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে বাহিনীর ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটা তাদের পরামর্শেই ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাদের সকল প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল। যেভাবে তারা বাহিনীটাকে তৈরি করেছে, তারা তো সেভাবেই কাজ করছে বলে আমার বিশ্বাস। তাহলে কেন তারা এই নিষেধাজ্ঞা দিল? এটা আমার কাছেও বিরাট এক প্রশ্ন।’
শেখ হাসিনার কাছে ইয়ালদা হাকিম জানতে চান, তাহলে কেন তারা এটা করেছে বলে তিনি মনে করেন?
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি না, হয়ত তারা আমার কাজ অব্যাহত থাকুক তা চায় না, আমি বাংলাদেশের জন্য যেসব উন্নতি করেছি, সেটা তারা হয়ত গ্রহণ করতে পারছে না। এটা আমার অনুভূতি। একটা পর্যায়ে সন্ত্রাস সব দেশের জন্য সমস্যা হয়ে উঠেছিল। আমাদের দেশে আমরা সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করেছি। এরপর মাত্র একটা ঘটনা ঘটেছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রাখতে কঠোর পরিশ্রম করেছে।’
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারির আগে বাংলাদেশে বন্দুকযুদ্ধের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন বিবিসির ইয়ালদা হাকিম। নিষেধাজ্ঞা জারির আগে ২০১৮ সালে ৪৬৬ জন মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। ২০১৯ সালে ৩৮৮ জন ও ২০২০ সালে ১৮৮ জন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পর এই সংখ্যা মাত্র ১৫ জনে নেমে এসেছে।
এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেসব নম্বর তারা উল্লেখ করেছে, সেগুলো তারা প্রমাণ করতে পারেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব হত্যাকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করেনি। কারণ, আমরা প্রমাণ চেয়েছিলাম। সেগুলো তারা পাঠিয়ে দিক, আমরা তদন্ত করে দেখবো।’
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচেভেলের একটি তথ্যচিত্রে দাবি করা হয়েছে, র্যাবের দুই কর্মকর্তা গোপন তথ্য ফাঁস করে বলেছেন, এসব হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসেছে। এই তথ্য তুলে ধরা হলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি না তারা কীভাবে এটা করেছে, কিন্তু আমেরিকায় কী ঘটছে, আপনি দেখতে পাচ্ছেন। সেখানে প্রায় প্রতিদিন একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এমনকি স্কুল, শপিং মল, রেস্তোরাঁয় হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এমনকি স্কুল শিক্ষার্থীরা, সাধারণ মানুষ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অথবা সশস্ত্র ব্যক্তির হাতে নিহত হচ্ছে। আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজেদের ব্যাপারে আরও মনোযোগী হওয়া। তাদের দেশের কী অবস্থা? তাদের উচিত শিশুদের জীবন রক্ষা করা। তারা নিজেদের লোকজনের ব্যাপারে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারা যেসব অভিযোগ করেছে, আমরা তাদের কাছে প্রমাণ চেয়েছিলাম। তারা দেয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞা একটা খেলার মতো। এটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার নয় কেন তারা আমাদের দেশের প্রতি নিষেধাজ্ঞা দিলো?’
শেখ হাসিনা নিজের পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা তুলে ধরে বলেন, ‘এই খুনিরা দায়মুক্তি পেয়েছিল। আমি এমনকি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারিনি। আমার বিচার পাওয়ার কোনও অধিকার ছিল না। সেই সময় তারা কোনও নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। বরং একজন হত্যাকারী আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাদের বারবার অনুরোধ করেছি, তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য। তারা করেনি। কেন তারা শুনছে না, আমি জানি না।’
জাতীয় সংসদে গত এপ্রিলের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী এক বক্তব্যে বলেছিলেন, আমেরিকা বাংলাদেশের ক্ষমতায় পরিবর্তন আনতে চায়। এই বক্তব্যের পক্ষে কী প্রমাণ আছে বিবিসির পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়। এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছে একটা বড় প্রশ্ন হলো, কেন তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করলো? যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের সন্ত্রাস মোকাবিলার জন্য কাজ করছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তখন তারা লঙ্ঘনকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যারা ভুক্তভোগী, তাদের পক্ষে নয়।’
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘ, সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে- এই তথ্য শেখ হাসিনাকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি ১২টি প্রতিষ্ঠান মিলে এসব বক্তব্য দিয়েছে, কিন্তু তারা প্রমাণ করতে পারেনি। আমি জানি না কী আন্তর্জাতিক খেলা চলছে।’
কেন তারা আপনাকে সরাতে চাইবে? ইয়ালদা হাকিমের এই প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা আমার পিতাকে হত্যা করেছে। যারা আমার পরিবারকে হত্যা করেছে, এমনকি ১০ বছরের ভাইকে হত্যা করেছে, সেই ষড়যন্ত্রকারীরা চায় না এই পরিবারের কেউ ক্ষমতায় আসুক।’
বিবিসির পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশের বিরোধী নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, শেখ হাসিনা নির্বাচন কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছে?
এর জবাবে শেখ হাসিনা বলছেন, ‘অবশ্যই না। নির্বাচন এবং ভোটাধিকারের জন্য আমি সারাজীবন ধরে সংগ্রাম করেছি, সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে। নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য আমরাই আইন করেছি। আমরা সবসময়েই চেয়েছি যেন মুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচন হয়। এখন আমাদের ভোটার লিস্ট ছবিসহ তৈরি করেছি, আমরা স্বচ্ছ ব্যালট বক্সের ব্যবস্থা করেছি।’
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মানবাধিকারের কথা বিবেচনা করেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
ইয়ালদা হাকিম তাঁর কাছে জানতে চান, আপনি যখন তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, বিশ্বের কাছে অনেক প্রশংসা পেয়েছেন। তাদের বিপদের সময় ১০ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন। বাংলাদেশকে, আপনাকে তারা প্রশংসা করেছে। কিন্তু পাঁচ বছর পরে কী হচ্ছে? সেখানে সংখ্যাতিরিক্ত মানুষ বসবাস করছে, ক্যাম্পে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটছে, সহিংসতা হচ্ছে। তাদের আরেকটি দ্বীপে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে?
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেখানে যারা গিয়েছে, তারা অনেক ভালো অবস্থায় বসবাস করছে। কারণ সেখানে এক লাখ পরিবারের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। কে বলেছে সেটা বন্যা প্রবণ? বন্যা ঠেকাতে সেখানে সবকিছুই করা হয়েছে। সেখানে ভালো স্কুল, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রয়েছে। ক্যাম্পের চেয়ে সেখানে বসবাসের ব্যবস্থা অনেক ভালো।’
তিনি বলেন, ”এখন যেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প, ওই এলাকার পরিবেশ পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে। ওখানে গভীর জঙ্গল ছিল, সেটা এখন নেই। তারা এখন একে অপরের সঙ্গে মারামারি করছে। তারা মানব পাচার, মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।‘’
‘এ ধরনের অভিযোগ করার আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রোহিঙ্গারা যাতে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা। তাদের (রোহিঙ্গাদের) উচিত নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়া।’
বিএনএ/এমএফ, হাসনা, বি রহমান