বিএনএ ডেস্ক: সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টার বয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনও বটে। বর্তমানে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এই অধিনায়কের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কাজে লাগাতে কয়েক বছর আগে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিনিয়োগকারীদের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে তাকে দিয়ে বানানো হয় টেলিভিশন বিজ্ঞাপনও। বিএসইসির এই বিশেষ দূতের নামই এবার জড়িয়ে পড়েছে শেয়ার কারসাজির সঙ্গে।
সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সাতটি কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি করে যে চক্রটি ১৩৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বলে বিএসইসির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, সেই চক্রের সঙ্গে নাম এসেছে দেশসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানেরও। বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগ কারসাজির ঘটনায় যে সাতটি প্রতিবেদন করেছে, সেখানে কমপক্ষে দুটিতে সাকিবের বিও হিসাবের কথা উল্লেখ আছে। আর কয়েকটির মধ্যে তার মালিকানাধীন কোম্পানি মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেডের নাম এসেছে।
এসব কারসাজিতে মূল অভিযুক্ত পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত-সমালোচিত মুখ আবুল খায়ের হিরু। সমবায় অধিদপ্তরের প্রথম শ্রেণির এই কর্মকর্তার ব্যবসায়িক পার্টনার সাকিব আল হাসান। যদিও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম দৈনিক বাংলাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তদন্তের পর সাকিবকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তদন্তে প্রথমে তো অনেক নাম আসে। পরে তাদের সঙ্গে কথা বলে কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় কে আসলে জড়িত। তাদের কথা ঠিক হলে তাদের অব্যাহতি দেয়া দেয়া হয়।’
তবে যে তদন্তে সাকিবের নাম এসেছে, সেখানে কারসাজিকারীর সঙ্গে নাম আসা ব্যাক্তিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের একটি সারসংক্ষেপ দেয়া আছে এবং সেটার পরেই কারসাজি ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে জরিমানা করেছে বিএসইসি।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হিরুর মালিকানাধীন দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেড অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট এশিয়ান ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা মুনাফা করে। এই কারসাজির সহযোগী হিসেবে সাকিবের নাম এসেছে। হিরুর মালিকানাধীন এই কোম্পানি যখন শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়েছে, সেখানে অবদান ছিল সাকিবেরও।
এ ছাড়া আবুল খায়েরের বোন কনিকা আফরোজ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে এক জায়গায় ও আবুল খায়েরের বাবা আবুল কালাম মাতবর অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে দুই জায়গায় সহযোগী হিসেবে সাকিবের নাম পাওয়া যায়। এসব কারসাজির জন্য বিএসইসি মোট ১০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। তবে এই তালিকায় ছাড় পেয়েছেন সাকিব।
বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগের চলতি বছরের ২০ জুনের চিঠি থেকে জানা যায়, আবুল খায়েরের মালিকানাধীন দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেড এশিয়ান ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে। ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবরের মধ্যে এশিয়ান ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেড। এ সময় বিমা কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৩০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৬৮ টাকা ৬০ পয়সা হয়। এতে তারা মুনাফা করে ৩ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪২ টাকা। এ সময় তাদের আনরিয়েলাইজড গেইন বা সম্ভাব্য মুনাফা ছিল ৫ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার ২২৫ টাকা। পরে আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভকে জরিমানা করা হয়েছে ৭২ লাখ টাকা।
গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনাটি ঘটে হিরুর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের নামে। ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ৬ জুনের মধ্যে বিমা কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে কাজী সাদিয়া হাসান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট। এ সময় তারা মুনাফা করে ১ কোটি ৮৮ লাখ ২৮ হাজার ১৪ টাকা। এ সময় তাদের আনরিয়েলাইজড গেইন হয় ৫৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৯১ টাকা। কারসাজির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পরে কাজী সাদিয়া হাসান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটকে জরিমানা করা হয় ৪২ লাখ টাকা।
২০২১ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ৩ মের মধ্যে ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে কাজী সাদিয়া হাসান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট। এ সময় তারা মুনাফা করে (রিয়েলাইজড গেইন) ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৬১ হাজার ৪০৫ টাকা। আর আনরিয়েলাইজড গেইন ছিল ৯৫ লাখ ৫১ হাজার ৭০৫ টাকা। পরে প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করা হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা।
এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার নিয়েও কারসাজি করে চক্রটি। বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগের গত ৬ জুলাইয়ের চিঠি থেকে জানা যায়, হিরুর বোনের খোলা কনিকা আফরোজ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট এই ব্যাংকটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে। ২০২১ সালের ৫ মে থেকে ২৪ মের মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে কনিকা আফরোজ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট। এ সময় তারা মুনাফা করে (রিয়েলাইজড গেইন) ১৫ কোটি ২২ লাখ ৯৯ হাজার ৬০৮ টাকা। আর আনরিয়েলাইজড গেইন হয় ২৩ কোটি ৩৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮৭২ টাকা। পরে কনিকা আফরোজ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটকে জরিমানা করা হয় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘এ বিষয়গুলো তো বিএসইসির দেখার কথা। পুরো পুঁজিবাজার এখন জুয়াড়িদের হাতে। বিনিয়োগকারীদেরও একটি বিশাল অংশ মনে করেন, ওরা না থাকলে মার্কেটে প্রাণ থাকবে না। দেশের পুঁজিবাজার যখন পড়ে গেছে, তখন জুয়াড়িদের ডেকে চা খাইয়েছে কমিশন।’
বিএনএনিউজ২৪/ এমএইচ