বিএনএ, ঢাকা: সালমান এফ রহমান। যার আরেক নাম দরবেশ। বেশভূষায় দরবেশ নামটি যথার্থ। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজনীতিতেও ছিল তার সমান বিচরণ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও শেয়ার বাজারে তার ক্ষমতা চর্চা ছিল অসীম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণর থেকে শুরু করে শীর্ষ পদের কর্মকর্তারা তার কথায় উঠবস করতেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের চার কর্মকর্তার যোগসাজসে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে ৩ কোটি ডলার নামে মাত্র সুদে ঋণ সহায়তা নেন।
প্রসঙ্গত, তার কথা অনুযায়ী কাজ না করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন গভর্ণরকে ‘চড়’ মেরে ছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৬-০৭ সালের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী একটি টাস্কফোর্স করা হয়েছিল। টাস্কফোর্স বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য বের করেন যে, ১২২ জন রাজনৈতিক নেতা ও আমলা দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ মোট ১৭টি দেশে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া ৪৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এক হাজার কোটি টাকা সালমান এফ রহমানের। আমেরিকায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসার নামে এসব টাকা পাচার করা হয়েছে।
হাজারো ব্যবসায়ীকে পথে বসানো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির এক অবিচ্ছেদ্য নাম সালমান এফ রহমান। তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন দেশের পুজিঁ বাজার। তাকে বলা হয় শেয়ার বাজারের কারিগর। ২০০৯ সালের পর থেকে অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. ইউনূস ক্ষমতাগ্রহণের আগ পর্যন্ত তার কারসাজিতে চলতো শেয়ার বাজার।
২০১০-১১ সালে শেয়ার বাজার ধসের পর এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর, অর্থনীতিবিদ খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। রিপোর্টে তিনি সালমান এফ রহমান থেকে পুজিবাজারকে সতর্ক রাখার পরামর্শ দেন।
রিপোর্টে পুঁজিবাজারে ফিক্সড প্রাইস, বুক-বিল্ডিং, রাইট শেয়ার, ডিরেক্ট লিস্টিং, সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, প্রেফারেন্স শেয়ারসহ সকল ক্ষেত্রেই অনিয়ম হয়েছে এবং এর সঙ্গে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়।
এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন কোম্পানির প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রমাণ পায় কমিটি। অথচ এসব অনিয়মের সঙ্গে সালমান এফ রহমানসহ আরও কয়েকজনের নাম জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সূত্র জানায়, সালমান এফ রহমানের বিভিন্ন অপকর্মের মধ্যে জমি জালিয়াতি অন্যতম। ঢাকার কালিয়াকৈরে সাধারণ মানুষের প্রায় ২৪১ একর জমির জাল দলিল করার মতো প্রতারণার সঙ্গে তিনি জড়িত বলে অভিযোগ আছে।
২০০০ সালের দিকে বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট লি. এসব জমির ভুয়া দলিল নিয়ে আইএফআইসি ব্যাংকে গিয়েছিল, বড় অঙ্কের ঋণের জন্য। ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পরবর্তীতে এসব জমির ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারেন- জমিগুলো আসলে ক্রয়ই হয়নি। জমির মালিকরা আতঙ্কিত হয়ে গাজীপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের শরণাপন্ন হলেও তিনি তাদের সাহায্য করেননি।
এরপর তারা তৎকালীন ইউএনওর কাছে গেলে তিনি তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ব্যক্তিগতভাবে ইউএনও খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হন যে, প্রকৃত মালিকরা বেক্সিমকোর কাছে জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি। বরং রেজিস্ট্রি অফিসে ভুয়া মালিক সাজিয়ে এসব দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এরপর ইউএনও লিখিতভাবে বেক্সিমকো প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট লি. কে নোটিশ পাঠান। এই সময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি ওই ইউএনওকে নানা লোভ এবং ভয়ভীতি দেখিয়েও ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে ইউএনও নিজে বাদি হয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। এই জমি জালিয়াতির সঙ্গে সালমান এফ রহমান সরাসরি জড়িত দাবি করে তিনি আর্জির সঙ্গে ১০৮ পৃষ্ঠার তথ্যপ্রমাণও জুড়ে দেন। তবে সালমান বা তার প্রতিষ্ঠানের কিছুই হয়নি বরং শেষ পর্যন্ত বদলি হন সেই ইউএনও।
এতকিছুর পরও তাকে স্পর্শ করার সাহস হয়নি কারও। কেননা তার ক্ষমতার উৎস ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মূলত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সালমান এফ রহমান। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবসায়ী নেতার পর ২০১৮ সালে এমপি ও টানা দুইবার প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন। তার বিরুদ্ধে সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ব্যবসায়ীদের জোরপূর্বক গণভবনে নিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর পাশে আছি’ বলে বক্তব্য দেওয়ানোর অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দাড়ি কেটে, সাদা চুল কালো করে, লুঙ্গী পড়ে, পুরাতন একটি টি শার্ট গায়ে দিয়ে নৌপথে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন কোস্টগার্ডের হাতে। এরপরই দরবেশ খ্যাত সালমান এফ রহমানের সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। প্রধম ধাক্কায় আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালক পদ হারিয়েছেন তার ছেলে সায়ান ফজলুর রহমান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ঋণখেলাপির কারণে আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালক পদে সায়ান ফজলুর রহমানের পুনঃনিযুক্তির প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই। গত ২৭ জুন আইএফআইসি ব্যাংকের ৪৭তম বার্ষিক সাধারণ সভায় আহমেদ সায়ানকে পরিচালক পদে পুনঃনির্বাচিত করা হয়েছিল। বর্তমানে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে আছেন সালমান এফ রহমান। তার পদত্যাগের দাবিতেও আন্দোলন হচ্ছে ব্যাংকটিতে।
বিএনএনিউজ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম/এইচমুন্নী