বিএনএ, ঢাকা: কলকাতায় খুনের শিকার ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ঢাকায় ও কলকাতায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা জানিয়েছেন, ১৩ মে রাতে খুন করা হয় আজীমকে। যদিও হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশ হয় ২২ মে। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু আইনগত জটিলতার কারণে আনোয়ারুল আজীম আনারের সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়নি। কারণ, তাঁর মৃত্যুর সংবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংসদ সচিবালয়কে এখনও কোনো পক্ষ জানায়নি। শুধু গণমাধ্যমের খবরের উপর ভিত্তি করে কোনো আসন শূন্য ঘোষণা করার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সংসদের আইন শাখার কর্মকর্তারা।
গত ৫ জুন দ্বাদশ সংসদের তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশন শেষ হয় ৩ জুলাই। প্রায় এক মাসের এই অধিবেশনে ঝিনাইদহ-৪ কালীগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
সাধারণত কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যেই আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। সংসদ সদস্য মারা গেলে স্পিকার শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করেন। সংসদের অধিবেশন চলাকালে কেউ মারা গেলে ওই দিনের জন্য অধিবেশন মুলতবি করার রেওয়াজ আছে।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের ঘটনাটি ব্যতিক্রম। অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এ জন্য জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে আরও অপেক্ষা করা হবে। আমাদের সামনে কোনো নজির নেই। কার্যপ্রণালি বিধিতেও এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।’
কোনো সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করলে কিংবা অনুমতি ছাড়া ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে পদ শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়। এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনকে জানায় সংসদ। নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচনের আয়োজন করে।
স্পিকার বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে, তাঁর দেহ পাওয়া যায়নি। আমাদের কোনো একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে জানতে হবে। ওনার মৃত্যুসনদ বা কোনো কাগজ আমাদের কাছে আসতে হবে। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।’
সদস্যদের আসন শূন্য হওয়া সংক্রান্ত সংবিধানের ৬৭ (১) এ উল্লেখ আছে, কোন সংসদ-সদস্যের আসন শূন্য হইবে, যদি (ক) তাঁহার নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে নব্বই দিনের মধ্যে তিনি তৃতীয় তফসিলে নির্ধারিত শপথগ্রহণ বা ঘোষণা করিতে ও শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করিতে অসমর্থ হন। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ মেয়াদ অতিবাহিত হইবার পূর্বে স্পীকার যথার্থ কারণে তাহা বর্ধিত করিতে পারিবেন।
(খ) সংসদের অনুমতি না লইয়া তিনি যদি একাধিক্রমে নব্বই বৈঠক-দিবস অনুপস্থিত থাকেন।
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম দ্বাদশ জাতীয় সংসদের গত ২ মে দ্বিতীয় অধিবেশনে যোগদান করেন। এই অধিবেশন শেষ হয় ৯ মে। দ্বিতীয় অধিবেশন শেষ করে ১২ মে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতের কলকাতায় যান এবং কলকাতার বন্ধু গোপালের বাসায় ওঠেন। পরের দিন যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারি বাংলাদেশি বাল্য বন্ধু আখতারুজ্জামান শাহীনের নিউটাউনস্থ সন্জীবা গার্ডেনের বাসায় যান। সেখানেই তিনি হত্যার শিকার হন। প্রথমে চেতনানাশক ক্লোরফর্ম দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে পরে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। অতপর ছবি তুলে কিলিং স্কোয়ার্ড লিডার শিমুল ভুঁইয়া বাংলাদেশে অবস্থানরত শাহীনের কাছে পাঠায়। শাহীন সেই ছবি পাঠায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর কাছে। চেয়ারে বসা লাশের ছবির সঙ্গে শাহীন লিখেন ‘আনার শেষ, নমিনেশন কনফার্ম’। পরবর্তীতে শিমুল ভূঁইয়া বাংলাদেশে ফিরে একই ছবি মিন্টুর ক্যাডার হিসাবে পরিচিত ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ প্রকাশ গ্যাস বাবুর মোবাইলে পাঠায়। তারা ফরিদপুরে ভাঙ্গা হাইওয়ে এলাকায় বৈঠক করে। ওই বৈঠকে শিমুল ভূঁইয়া চুক্তির বাকী ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রদানের জন্য চাপ দেয়। ২৩ মে সাইদুল করিম মিন্টু থেকে টাকা এনে দেওয়ার কথা শিমুল ভূঁইয়াকে জানিয়েছিল কাজী কামাল আহমেদ প্রকাশ গ্যাস বাবু।
অবাক ও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ছবি মোবাইলে নিয়েই গত ২৫ মে ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু এবং ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ সংসদ সদস্যের কালীগঞ্জ উপজেলার নিশ্চিন্তপুরের বাড়িতে যান। সেখানে আনার কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনকে শান্তনা দিতে গিয়ে সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, আমি এতিমের সঙ্গে আছি।
এদিকে কিলিং মিশনে সরাসরি নেতৃত্বদানকারি শিমুল ভূঁইয়া এবং শাহীনের কথিত বান্ধবী শিলাস্তি রহমান কলকাতা থেকে ফেরার পর ১৯ মে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হন। শিমুল ভূঁইয়ার স্বীকারোক্তির পর ৯ জুন গ্রেপ্তার হন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ। তার দুইদিন পর ১১ জুন ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার হন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। সেই সঙ্গে খসে পড়ে মিন্টুর মুখোশ। সামনে আসে মিন্টুর রাজনৈতিক উচ্চবিলাসী ষড়যন্ত্রের বিষয়টি। গ্যাস বাবু মিন্টুকে জড়িয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিলেও সাইদুল করিম মিন্টু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি।
প্রসঙ্গত, রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই রহস্যজনকভাবে তাকে আদালতে উপস্থাপন করে ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা। আদালতে মিন্টু দাবি করেন তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। তার অপরাধ তিনি ঝিনাইদহ- ৪ সংসদীয় আসন (কালীগঞ্জ) থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন।
দেখতে দেখতে দুই মাস পেরিয়ে গেছে। এখনো সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন এমন সংবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে পায়নি জাতীয় সংসদ সচিবালয়। অর্থাৎ সহসা ঝিনাইদহ-৪ সংসদীয় আসনটি শূন্য ঘোষণার সম্ভাবনা নেই। সেই ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের আসনটি শূন্য ঘোষণা করতে সংবিধান অনুযায়ী একাধিকক্রমে ৯০ কার্য দিবস অনুপস্থিতি গণ্য করা হবে বলে মনে করছেন সংবিধান বিশ্লেষকগণ।
বিএনএনিউজ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম/হাসনা