বিএনএ: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক নানা মন্তব্যে অসন্তোষ জানিয়ে কঠোর সমালোচনা করে আসছিল সরকার। তবে এবার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে মিশনে মিশনে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের তিন দিন আগে থেকে রাজপথ দখল করার উদ্দেশ্য ছিল বিএনপির। আর এতে উস্কানি দিয়েছেন দলটির গ্রেপ্তার নেতারা।
সোমবার (১২ ডিসেম্বর) ঢাকায় বিদেশি মিশনগুলোতে এই চিঠি দিয়েছে সরকার। তবে হঠাৎ করে এ ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যা পেয়ে কিছুটা অবাক হয়েছেন বিদেশি দূতরা।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানান, ঢাকার কূটনৈতিক মিশনগুলোকে সঠিক তথ্য দেয়ার লক্ষ্যেই এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারণ, যেকোনো ঘটনায় কূটনীতিকরা কিছু রাজনৈতিক কর্মীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। সেজন্য ৭ ডিসেম্বরের ঘটনার প্রকৃত কারণ তাদের জানানো হয়েছে।
এ চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে পশ্চিমা দেশের একজন দূত বলেন, ‘এ ধরনের একটি চিঠি পেয়েছি। বিষয়টি হজম করতে হচ্ছে।’
সরকারের তরফ থেকে ‘নন-পেপার’ হিসেবে এই চিঠি দেয়া হয়েছে কূটনীতিকদের। ব্যবহারিক অর্থে ‘নন-পেপার’ হলো কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থার এক ধরনের বেসরকারি দলিল, যা সাধারণত বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কিত। যে ব্যাপারে রাষ্ট্র বা সংস্থা কোনো সরকারি অবস্থান গ্রহণ করেনি, অথবা করলেও ঠিক এই পর্যায়ে তা প্রকাশ করতে আগ্রহী নয়। এ ধরনের পেপারের উদ্দেশ্য থাকে অন্যান্য সদস্যদের প্রতিক্রিয়া জানা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনায় সচলতা সৃষ্টি করা।
‘নন-পেপার’ পাঠানো নতুন কিছু নয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে ভুল তথ্য বা বিভ্রান্তি দূর করতেই এই তথ্য শেয়ার করা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক কূটনৈতিক অনুশীলনের মধ্যে পড়ে।’
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বিএনপি দেশে-বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং ৯ ডিসেম্বর বড় দেশগুলো নতুন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করবে এমন আশায় তারা ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ ডেকেছিল।’
কূটনীতিকদের দেয়া চিঠিতে বলা হয়, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। নয়াপল্টনের ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলায় উসকানি দেয়ার প্রমাণ পাওয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আটক করা হয়।
যা বলা হয়েছে চিঠিতে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে ৭ ডিসেম্বরের ঘটনার ব্যাখ্যায় বলা হয়, ‘বিএনপি ১০ ডিসেম্বরের জনসভায় প্রায় ২৫ লাখ মানুষকে ঢাকায় আনার ঘোষণা দেয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগে নিরাপত্তা, জনসাধারণের চলাচল এবং রাজধানীতে সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন করে বিএনপিকে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী সমাবেশের অনুমতি দেয় পুলিশ। কিন্তু সেখানে ৮ তারিখ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পূর্বনির্ধারিত কাউন্সিল ছিল। ওই অনুষ্ঠানের পরে তাদের প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে না জানিয়ে সেখানে সমাবেশ করতে রাজি হয়নি বিএনপি। কিন্তু ভেন্যু প্রস্তুতির কাজে বিএনপিকে পর্যাপ্ত সময় দেয়ার জন্য ছাত্রলীগের কাউন্সিল দুদিন এগিয়ে ৬ ডিসেম্বর করা হয়।’
‘কিন্তু তারপরও সঙ্গত কারণ না দেখিয়ে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভা করায় জোর দেয় বিএনপি, যেটা ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। যেখানে অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক ভবন রয়েছে। এমনকি নয়াপল্টন এলাকায় একটি ছোট জমায়েত জনসাধারণের চলাচলকে মারাত্মকভাবে ভোগান্তিতে ফেলে এবং পুরো শহরকে যানজটের মধ্যে ফেলে দেয়।’
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ৭ ডিসেম্বর দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা সড়ক অবরোধ করেন। ওই দিন তাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল না। এমনকি পুলিশের অনুমতিও তারা নেননি। অবরোধের কারণে নয়াপল্টন এলাকায় যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় পুলিশ তাদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু বিএনপির বিক্ষোভকারীরা তা অগ্রাহ্য করে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপের পাশাপাশি যানবাহন ভাঙচুর শুরু করেন। তাদের হামলায় পুলিশের ৪৯ জন সদস্য আহত হন, যাদের একজনের অবস্থা গুরুতর।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠিতে আরও উল্লেখ করে, ‘একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। দুঃখজনকভাবে সংঘর্ষের মধ্যে একজন পথচারী নিহত হন। তখন পুলিশ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ায় সম্পদের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেছে।’
১৯৭১ সালে ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২০ লাখেরও বেশি মানুষের সামনে ভাষণ দিয়েছিলেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘নয়াপল্টন বড় জমায়েতের জন্য উপযুক্ত নয়।’
পুলিশ বিএনপির কার্যালয় থেকে ১৬০ বস্তা চাল জব্দ করে জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ‘তিন দিন ধরে নেতা-কর্মীদের খাওয়াতে চাল আনা হয়। নির্ধারিত জনসমাবেশের তিন দিন আগে জোরপূর্বক ও বেআইনিভাবে রাস্তা দখল করা ছিল বিএনপির উদ্দেশ্য। বিএনপির কার্যালয়ে ককটেলও পাওয়া যায়।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের করা মামলার প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেপরোয়া সহিংসতার পরিকল্পনা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার জন্য দলীয় কর্মীদের উসকানি দেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্ভবত বিএনপি নেতারা অনুষ্ঠানস্থল থেকে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো ব্যস্ত জনপথে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা। তারা তাদের বেআইনি দাবি আদায়ের জন্য সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে চেয়েছিলেন।’
বিএনএ/এ আর