28 C
আবহাওয়া
৭:১৮ পূর্বাহ্ণ - সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » চুনতীর শাহ সাহেব কেবলা ও সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিলের ইতিকথা

চুনতীর শাহ সাহেব কেবলা ও সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিলের ইতিকথা

শাহ সাহেব

।।সৈয়দ মাহফুজ—উননবী খোকন।।

১৯ দিনব্যাপী ঐতিহাসিক চুনতী সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিল প্রবর্তন করেন অবিভক্ত সাতকানিয়া বর্তমান লোহাগাড়া উপজেলার চুনতীর আধ্যাত্মিক সাধক হযরত আলহাজ শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ প্রকাশ চুনতীর শাহ সাহেব কেবলা। তিনি একজন প্রখ্যাত সুফী সাধক এর সুযোগ্য সন্তান। শাহ সাহেব কেবলা ১৯২২ সালে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আধ্যাত্মিক সাধনা দিয়ে তিনি মানুষের খুব কাছে অবস্থান করেছিলেন। তিনি নিজ এলাকায় শাহ সাব মউ (মামা), চুনতীর শাহ সাহেব কেবলা নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করেন। ইসলামি সুফিবাদে বিশ্বাসী শাহ সাহেব আজীবন কাজ করে গেছেন ইসলামের আধ্যাত্মিক দর্শন প্রচারে।

শাহ সাহেব
শাহ সাহেব

তাকে যেভাবে দেখেছি:
সময়টা আমার বালক বেলার। তিনি ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরতেন সাথে সাদা দামি লুঙ্গি, নকশাল ছিদ্রযুক্ত সাদা টুপি থাকতো তার মাথায়। চোখে থাকতো কালো রঙের চশমা। গায়ে সুগন্ধি মাখতেন। আঙ্গুলে পরতেন দামি পাথরের আংটি। তার সাদাসিধে জীবনে আংটিটাই একটু আভিজাত্যের পরিচয় বহন করতো। তখন আমার বাবা—মা বেঁচে ছিলেন। মাঝে মধ্যে চুনতির শাহ সাহেব কেবলা আমাদের বাড়ি আসতেন, দু’য়েকদিন থাকতেন। আমাদের বাড়ি নিয়ে কিছুটা বলি। সে সময় গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তখন চেরাগ, হারিকেন, হেজাগ বাতির দিন। বাড়ির কাজে সাহায্য করার জন্য তখন অন্তত পাঁচ সাতজন নারী—পুরুষ গৃহকর্মী ছিল আমাদের বাড়িতে। শাহসাহেব মামা রং চা পান করতেন। খুব দামি থ্রিকেস সিগারেট বা ক্যাপস্টেন সিগারেট খেতেন শাহ সাহেব মামা। তার জন্য সেটি আমিই সাতকানিয়া দেওয়ানহাট বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসতাম। বর্তমানে এই সিগারেট বাজারে নেই।

শাহ সাহেব মাজার
শাহ সাহেব মাজার

শাহ সাহেব যখন আমাদের বাড়িতে আসতেন তার পুত্র জামাল সাহেব, মেয়ে জামাই শিবলি, মানিক (চুনতি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ) সবাই আসতেন। মাঝে মধ্যে শাহ সাহেবের সহধর্মিণীও আসতেন। সময়টা আমাদের জন্য খুবই আনন্দের ছিল। তার আসা উপলক্ষ্যে গল্প-গুজব, খাওয়া-দাওয়া, চা-নাস্তা সবই আমাদের বাড়িতে তৈরি করে পরিবেশন করা হত সবাইকে। উনার সান্নিধ্য পেতে অনেকেই ছুটে আসতেন আমাদের বাড়ীতে। উৎসবমুখর হয়ে উঠতো আমাদের বাড়ি। এছাড়াও তিনি ভোয়ালিয়া পাড়ার জব্বর মিয়ার বাড়ি, রফিউল কাদের বাড়ি, ছমদরপাড়ার শেঠ আবদুল জলিল (শেঠ সাহেবের বাড়ি) যেতেন। তিনি আমাদের মাঝে নেই তবুও অনুভবে থাকবেন অনন্তকাল।

চুনতী সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিল শুরুতে আয়োজক উদ্যোক্তা অন্য কেউ ছিলনা। এ মাহফিলের শুরুতে মূল উদ্যোক্তা হিসেবে ভূমিকা ছিল আমাদের। সাতকানিয়া উপজেলা ও পৌরসভা সদরের ভোয়ালিয়াপাড়ায় “রূপকানিয়া সমাজ কল্যাণ সমিতির (রুসকস) আমি সহ ৩৫/৪০ জন সদস্য এ মাহফিলের মূল উদ্যোক্তা। আমাদের সাথে ছিলেন মরহুম শেঠ আবদুল জলিল, মরহুম সৈয়দ সাদউল্লাহ, ডা. মোজহারুল হক, রফিউল কাদের, জব্বার মিয়া, আবুল হোচন সাচি ডাক্তারসহ ভোয়ালিয়াপাড়ার রুপকানিয়া সমাজ কল্যাণ সমিতির (রুসকস) বয়োজ্যেষ্ঠ তরুন যুবক সদস্যবৃন্দসহ অনেকে। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকজন ইহজগতে নেই। ২৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত তৎকালীন সাতকানিয়া থানা। পরে সাতকানিয়ার ২৬ ইউনিয়ন থেকে ভাগ হয়ে ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে লোহাগাড়া থানার উদ্বোধন করা হয়। এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী এজি মাহমুদ। সাথে আমিও ছিলাম। চুনতী শাহ সাহেব কেবলার বাড়ির সামনে উঠানে আমরা ঈদে মিলাদুন্নবী (স:) শেষে সবাইকে খাবার পরিবেশন করতাম। তখন বিদ্যুৎ এসেছে। একদিন খাবার পরিবেশনকালে বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন আমরা মোমবাতি জ্বালিয়ে একহাতে মোমবাতি অন্যহাতে চুনতিতে আগত লোকজনকে খাবার পরিবেশন করতাম। এসময় মোমবাতি গলে হাতের আঙুলে গলে পড়তো। এ নিয়ে খুব যন্ত্রণাও ছিল। এসব স্মৃতি নিয়ে ভাল লাগা আর নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই আজও।

 

পরবর্তীতে চুনতির হিরন চেয়ারম্যান, মোসলেম খান, বাজালিয়ার আলহাজ্ব মকবুল আহমদ সাহেব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সিটি কলেজের পশ্চিম পাশে চুনার গোদাম এলাকার শাহ সাহেব কেবলার এক ভক্ত সহ অনেককেই পেয়েছি। পর থেকে অনেক আলেম ওলামা ও সুফি সাধকদের পাই। তখন ঈদে মিলাদুন্নবী সঃ এর পরিবর্তন করে চুনতি সীরাতুন্নবী সঃ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। মাহফিলে ঢাকার আজিমপুর দায়রা শরীফের পীর হজরত দায়েম উল্লাহ, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার, শিক্ষা উপদেষ্টা সৈয়দ আলী আহসান ও এসেছিলেন। সীরাতুন্নবী মাহফিলে গারাঙ্গীয়ার পীর হজরত আবদুর রশিদ হামেদী, পীরে কামেল হযরত মাওলানা আবদুল জব্বার, পীরে কামেল আলহাজ মাওলানা কুতুবুদ্দীন, হজরত মাওলানা আমিনুল্লাহ সাহেব, হজরত মাওলানা শফিক আহমদ, হজরত মাওলানা মোবারক আহমদ সাহেব সহ প্রখ্যাত আলেম ওলামা মশায়েখগন চুনতীর সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিলে আসেন। সেই সময় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে মাদ্রাসা বিল্ডিং এর দোতলায় উপরে খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল। ভিআইপিদের সেখানে খাবার দেয়া হত। নিচতলায় মাহফিলে আসা সাতকানিয়ার লোকজন থাকার জন্য ব্যবস্থা ছিল মাহফিল কমিটির পক্ষ থেকে। বর্তমানে এ সীরাতুন্নবী মাহফিল ১৯ দিন ধরে চলে।

তখন চুনতি শাহ সাহেব এর বাড়ীর সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে সীরাতুন্নবী (স:) এর মাহফিল হতো। এর পর সীরাতুন্নবী (স:) কমিটি অনুভব করলেন সিরাত মাহফিলের জন্য বিশালাকার জায়গা প্রয়োজন হবে। তাই শাহ সাহেব এর বাড়ীর পশ্চিম পাশে বিশালাকার দুটি পাহাড়গুলো নেয়া হলে সীরাতুন্নবী (স:) মাঠের পরিধি বিশাল হবে। সাতকানিয়া উপজেলা ও পৌরসভা সদরের ভোয়ালিয়াপাড়ার নৌকাঘাট হাসমত আলী দারোগা বাড়ীর আমাদের জ্যাটাই শাকেরা খানমের ভাই রফিখাঁ ও মলিখাঁ’ ও সলুখাঁর বিশাল পাহাড়গুলো নিয়ে মাঠের সম্প্রসারন করতে হবে। পাহাড় গুলোতে শ্রদ্ধাভাজন রফিখাঁ, মলি খাঁ, সলুখাঁর ও পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। সীরাতুন্নবী (স:) কমিটি ওনারা তাদের পরিবার পরিজনদের জন্য সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিলের পশ্চিম ও দক্ষিণে অন্য পাহাড়ে স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর পাহাড় কেটে সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিলের জন্য বিশালাকার মাঠ তৈরি করা হয়।

এক সময় চুনতি ছিল সাতকানিয়ারই অংশ। এর আগে লোহাগাড়া উপজেলা ছিল সাতকানিয়া উপজেলার অংশ। তখন ২৬ টি ইউনিয়ন নিয়ে ছিল সাতকানিয়া থানা। পরবর্তী সময়ে থানাকে উপজেলায় রুপান্তর করা হয়। সাতকানিয়ার ২৬ টি ইউনিয়ন থেকে চুনতি, আধুনগর, পুটিবিলা, বড়হাতিয়া, কলাউজান, পদুয়া, আমিরাবাদ, চরম্বা ও লোহাগাড়া ইউনিয়ন কে সাতকানিয়া থেকে কেটে মোট ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে লোহাগাড়া উপজেলা গঠন করা হয়।

ঈদে মিলাদুন্নবী (স:) ও সীরাতুন্নবী (স:) আয়োজনের সময়কাল

১৯৭২ সালে ১দিন ব্যাপী পরবর্তী সময়ে সীরাতুন্নবী মাহফিল পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে ৩, ৫, ১০, ১২, ১৫ ও ১৯দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

১৯ দিন ব্যাপী ৫৪তম আন্তর্জাতিক মাহফিলে সীরাতুন্নবী (স:) আগামী ১৫ ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ইং, ১১ই রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি, ৩১ শে ভাদ্র ১৪৩১ বাংলা, রবিবার ১৯ দিন ব্যাপী ৫৪তম আন্তর্জাতিক মাহফিলে সীরাতুন্নবী (স:) ১ম অধিবেশন বাদ যোহর আরম্ভ করার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।

মাহফিলের শেষদিন আখেরী মুনাজাত

মাহফিলের সমাপ্তির দিনে দিবাগত রাতে ভোর পর্যন্ত লাখো ধর্মপ্রান মুসল্লিদের সমাগমে আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিলের সমাপ্তি করা হয়।

সীরাতুন্নবী (স:) উপলক্ষে বাপের বাড়ীতে নায়র আসা

দু’য়েক বছর পর থেকে চুনতি সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিলের সময়ে চুনতির মেয়েরা বাপের বাড়ীতে নায়ওর আসার প্রথা চালু করা শুরু হলো। এ সময় প্রায় চুনতির প্রতিটি বাড়ীতে নায়ওর আসার সাথে তাদের ছেলে—মেয়েরা নানার বাড়ী বেড়ানোর সুযোগ হয়। সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিল উপলক্ষে অন্তত বছরে একটা মাস বা কিছু সময় নায়র আসা শুরু করে মেয়েরা। তাদের ছেলে-মেয়েরা নাতি-নাতনীদের ও নানা-নানির বাড়ীতে আসার আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি সীরাতুন্নবী (স:) মাহফিলে অংশগ্রহণ করে আসছে।

চুনতি শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে
চুনতির লোকজন শিক্ষিত। ছোট বেলায় দেখেছি ছোট—বড় সকলে আদব-কায়দা নীতি-নৈতিকতা ছিল। ছোট-বড় সকলে একে অপরের সাথে সম্মান শ্রদ্ধা করতো। তখন সামাজিকতা পরস্পর পরস্পরের সাথে অত্যাধিক সম্মান-শ্রদ্ধা করতো। স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা একে অপরের সাথে সাধুভাষায় এবং মাঝে মাঝে ইংরেজিতে কথা বলার চর্চা করতে দেখা যেত।

চুনতীর শাহ সাহেব কেবলার ইন্তেকালঃ
১৯৮৩ সালে হযরত আলহাজ¦ শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ প্রকাশ চুনতীর শাহ সাহেব কেবলা ইন্তেকাল করেন। চুনতীর সীরাতুন্নবী (স:) ময়দানে মসজিদে বায়তুল্লাহর দক্ষিণ পাশে শাহ সাহেব কেবলাকে সমাহিত করা হয়।

লেখক : সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা, সাতকানিয়া প্রেসক্লাব

Loading


শিরোনাম বিএনএ