বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র একটি প্রামাণিক গ্রন্থ যা ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত এ তথ্য ভাণ্ডারে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষের অজানা। বিশেষ করে এ প্রজন্ম জানেই না কত রক্ত, কত কষ্ট, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্জন ও উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাঙ্গালি জাতি বিলীন হয়ে যেত! এমনটাই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানাতে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে।
আজ প্রকাশিত হলো
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭০
২ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা আজ শত্রুমুক্ত। এইসব জায়গায় আজ মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় গ্রামবাসী প্রতিটি গ্রামকে দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো করে গড়ে তুলেছে। যে হাত কেবল লাঙল ধরতো, কিংবা কলম ধরতো, কিংবা যে হাতে একতারা শোভা পেতো- সেই হাত, সেই একই হাত আজ তুলে নিয়েছে রাইফেল।
এইসব এলাকা কয়েকদিন আগে ঘোরার সময় খান সেনাদের অত্যাচারের চিহ্ন দেখেছি, শুনেছি তাদের বর্বরতার কথা, জেনেছি মুক্তিবাহিনী ও গ্রামবাসীর সম্মিলিত ক্রমাগত যুদ্ধের কথা, জয়ের কথা। তরূণ যোদ্ধাদের সাথে ভাব-বিনিময় করেছি এবং বারবার অনুভব করেছি কি গভীর আমাদের দেশের মানুষের দেশপ্রেম; কি প্রচণ্ড সংগ্রামের, যুদ্ধের ইচ্ছা তাদের। এবং কি কঠিন পণ নিয়েছে তারা সবকিছু উৎসর্গ করে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার।
এসব জায়গায় যে কদিন খান সেনারা ছিল, সে কদিন তারা গ্রামগুলোর ওপর দিয়ে অত্যাচারের ঝড় বইয়ে দিয়েছে। বহু মানুষের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়েছে, ফসলের ক্ষতি করেছে, বাজার দোকানপাট জ্বালিয়েছে, লুট করেছে, অনেকের পাকা বাড়ী ভেঙ্গে ইট নিয়ে বাঙ্কার বানিয়েছে। খেয়াল খুশীমতো হত্যা করেছে মানুষকে, অত্যাচার করেছে মেয়েদের ওপর।
এইসব অন্যায়-অত্যাচারের মধ্য দিয়ে মানুষ পদদলিত, শোষিত মানুষ জেগে উঠেছে। তাদের চোখে এখন শত্রু হননের আকাঙ্ক্ষা। জীবনের শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ এখন যুদ্ধ করে যেতে চায়। একজন গ্রামবাসী আমায় বললেন: যুদ্ধ তো সবে শুরু, এখনই কি জয়ের কথা বলেন। খান সেনাদের বিষদাঁত ভেঙ্গে না দেয়া পর্যন্ত জয় কিসের। আমাদের হাতে অস্ত্র ছিলো না তাই খান সেনারা ফাঁকা মাঠে কারদানি দেখিয়েছে, এখন তো আমরা সবে অস্ত্র ধরেছি, তার শোধ তুলবো না?
গ্রামের একজন যুবক বললেন, ‘অস্ত্র যখন ধরেছি তখন বেঁচে থাকতে খান সেনারা এই গ্রামে আর ঢুকতে পারবে না। চেষ্টাও তারা কম করেনি, ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও চেষ্টা করেছে, কিন্তু এখন মজাটা টের পেয়েছে তারা। এখন তারা মাইল সাতেক দূরে থানা গেড়েছে।’
সবখানেই এক মানসিকতা। খরচাপাতি কমিয়ে দিয়েছে সবাই। খাদ্যসামগ্রী জমিয়ে রাখছে ভবিষ্যতের জন্য। গ্রামের এখানে-ওখানে জঙ্গল হয়ে গেছে। আমাদের যোদ্ধাদের জন্য খুবই অনুকূল। গ্রামবাংলা যুদ্ধ ও জীবন সব এখন একাকার হয়ে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধারা এমন চতুরতার সঙ্গে খানসেনাদের ঘায়েল করে চলেছে যে আমাদের কোন প্রাণহানি হয় না বললেই চলে। তার কারণ নিজেদের পরিচিত দেশে যুদ্ধ করে চলেছে মুক্তিসেনারা। সহজে তারা দেশের মাটির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মানুষের শত্রু খানসেনারা তা পারে না। কাউকেই তারা বিশ্বাস করতে পারে না। দেশের মাটি ও পরিবেশ তাদের অনুকূল নয়। কারণ এদেশ তাদের নয়, এদেশকে তারা জানে না, এদেশের মানুষকে চেনে না, জানে না। তারা কেউ এদেশের নয়। তারা যে জোর করে এদেশে থাকতে চাইছে সেটি নিতান্তই অস্বাভাবিক ব্যাপার তাই তারা এদেশে থাকতে পারবে না, এদেশ থেকে তাদের চলে যেতে হবে, এদেশের মানুষই তাদের তাড়িয়ে দিবে। মাটির সঙ্গে ও মানুষের সঙ্গে যারা শত্রুতা করে তাদের এরকমই পরিণতি হয়ে থাকে।
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র -৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ৯৮) চলবে।
আগের পর্ব সমূহ :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬০
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা