বিএনএ,কক্সবাজার: প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ালেও তারা ছড়িয়ে পড়ায় শঙ্কার মধ্যে আছেন কক্সবাজারের বাসিন্দারা। নানা অজুহাতে সমুদ্র শহর কক্সবাজার ও সৈকতে রোহিঙ্গাদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়ার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে বলে মনে করেন কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী। ঈদুল আজহার পর পর গত কয়েক দিনে সমুদ্র সৈকতে পর্যটকের চাইতে রোহিঙ্গারা এসেছেন কয়েকগুন বেশি।
ট্যুরিস্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন কিছুতেই রোহিঙ্গাদের রোধ করা যাচ্ছেনা। গত রমজানের ঈদের পর ও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল তখন ট্যুরিস্ট পুলিশ ও কক্সবাজার মডেল থানা পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে প্রায় পা্চশ- রোহিঙ্গা আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাটিয়েছিল। একাধিক সূত্রের দাবি ক্যাম্প ছেড়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশ শিবিরে ফেরত যাচ্ছেনা। তারা মূল স্রোতে মিশে যাচ্ছে।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ মনিরুল গীয়াস বলেন, শহরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষা আর রোহিঙ্গাদের ভাষা মিল থাকায় কে রোহিঙ্গা কে বাংলাদেশি তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন কাজ। যে কারণে তারা কৌশলে পার পেয়ে যাচ্ছে। গত ১১ জুলাই সোমবার কলাতলী পয়েন্ট থেকে শতাধিক রোহিঙ্গা শনাক্ত করে ক্যাম্পে ফেরত পাটিয়েছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ।
‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ সংগঠনের সমন্বয়ক মো. কলিম উল্লাহ বলেন, ‘যেভাবে রোহিঙ্গারা কক্সবাজার শহরে অবস্থান নিয়েছে,হয়তো কয়েক বছর পরে এটি রোহিঙ্গা শহরে পরিণত হবে। রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য স্থানীয়রা প্রথমে নানা সুযোগ সুবিধা দেয়। ঘর ভাড়া থেকে শুরু করে দোকানের কর্মচারী, মজুর, রিকশা, ইজিবাইক চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছি। আমরা অনেকেই রোহিঙ্গাদের জমি বিক্রি এবং বিয়ে-শাদি করে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছি। এ কারণে কক্সবাজার শহরে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। বেড়েছে পর্যটক হয়রানি। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পর্যটকরা কক্সবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে’।
তিনি আরও বলেন, ‘কক্সবাজার শহর এবং শহরের বাইরে কতজন রোহিঙ্গা বসবাস করছে এর কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে পাঁচ বছর আগে থেকেই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শুধু মাত্র কক্সবাজার শহরে অবস্থান নিয়েছে। এর আগে থেকে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। কক্সবাজার শহরে এসব রোহিঙ্গার বেশিরভাগ রিকশা ও ইজিবাইক চালক। এদের কাছে প্রতিনিয়ত শুধু পর্যটক নয়, স্থানীয়রা নাজেহাল হচ্ছে।’এমন কি অনেক রোহিঙ্গা যুবক কন্ট্রাক কিলার হিসাবে ও কাজ করছে।
কক্সবাজার জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে কক্সবাজার শহরে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছে। জেলে, শ্রমিক, দোকান শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, রিকশা ও ইজিবাইক থেকে শুরু করে সব ধরনের শ্রমবাজার রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। মজুরি কম নেওয়ায় স্থানীয়রা রোহিঙ্গা শ্রমিকদের কাজ করাচ্ছে বেশি। বিশেষ করে কক্সবাজার শহরে রোহিঙ্গাদের বিচরণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ রোড হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোখিম খান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পর্যটন এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরা রয়েছে। সৈকতে ভাসমান ব্যবসা থেকে শুরু করে সবকিছু রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যাচ্ছে। তাদের খারাপ ব্যবহার, অশালীন আচরণ, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে রিকশা ভাড়া বেশি আদায়সহ নানা কারণে পর্যটকরা বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই বিচরণ বন্ধে সঠিক পদক্ষেপ নিতে কেউ এগিয়ে আসছে না।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আসার পথে নানা পুলিশি চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে কক্সবাজার শহরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে রোহিঙ্গা যুবক আমান উল্লাহ। সে প্রথমে নিজেকে রোহিঙ্গা পরিচয় দিতে না চাইলেও পরে স্বীকার করে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে কক্সবাজার শহরে এসেছে। রাতের অন্ধকারে কাঁটা তারের ঘেরাও কাটিয়ে পুলিশের নজর এড়িয়ে উখিয়া থেকে কক্সবাজার শহরে প্রবেশ করেছে সে। তার মতো শত শত রোহিঙ্গা তাঁর কেটে বাইরে চলে আসছে বলে জানিয়েছে সে।
এপিবিএনের এক কর্মকর্তা বলেন, কাঁটা তারের ঘেরাও এর নীচে মাটি কুড়ে রাতের অন্ধকারে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অনেক রোহিঙ্গা নারী পুরুষ।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়োজিত ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কাজ শুরু করার পর থেকে ক্যাম্প ছেড়ে পালানো সংখ্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্প নয়, ক্যাম্পের বাইরেও আমাদের তিনটি চেকপোস্ট রয়েছে। এসব চেকপোস্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা যাতে পারাপার করতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক আছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তারিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা আগমনের পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে। প্রতি বছর এ সময়ে রোহিঙ্গারা সভা-সমাবেশ করতে চায়। এই বছরে আর যাতে কোনও ধরনের সভা-সমাবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রতিটি ক্যাম্পে অবস্থানরত প্রধান রোহিঙ্গা নেতাদের নিষেধ করা হয়েছে।
তারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ৭ হাজার একর বনভূমির ওপর অস্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। দীর্ঘ পা্ঁচ বছর ধরে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গাকে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার পাশাপাশি কাজ করছে দেশীয় বিভিন্ন এনজিও।
বিএনএনিউজ২৪/ এমএইচ