বিএনএ, ডেস্ক : জুলাই ফাউন্ডেশনের অনুদানের টাকা নিতে অনেকে রাতারাতি বিপ্লবী সেজেছে। অনেক প্রতারক বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসা সনদ নিয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনে আবেদন করেছেন। যাঁদের কেউ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত, কেউ গাছ থেকে ফেলা ডাবের আঘাতে আহত, আবার কেউ পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন।

কিন্তু তাদের দাবি, তারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত হয়েছেন। যাচাই–বাছাইয়ের ফাঁক গলে গত ৭ মাসে অনেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বেশ কয়েকজন ধরাও পড়েছে। এর মধ্যে তিনজন প্রতারকের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা ফেরত আনা হয়েছে।
এদের অন্যতম ফারহানা ইসলাম ও মহিউদ্দিন সরকার। তারা সম্পর্কে মামি-ভাগনে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত দাবি করে গত রোববার তাঁরা সহায়তার টাকা নিতে গিয়েছিলেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে। কিন্তু সেখানে তাঁদের প্রতারণা ধরা পড়ে।
ফারহানা ও মহিউদ্দিন চিকিৎসার নথিপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু যাচাই করে দেখা যায়, তাঁরা দুজনে যে এক্স-রে রিপোর্ট দিয়েছেন, তা হুবহু এক।
ফারহানা ও মহিউদ্দিন স্বীকার করেন, তাঁরা আন্দোলনে আহতই হননি। চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কাগজপত্র তৈরি করে দিয়েছেন ফারহানা ইসলামের স্বামী নাজিরুল বাশার। নাজিরুল কেরানীগঞ্জের নিউ লাইফ জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একজন পরিচালক।
ফারহানা ও মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তারা এখন কারাগারে আটক রয়েছে। একই মামলায় আসামি করা হয় কুষ্টিয়ার জিয়াউল মালিক প্রকাশ দীপু মালে নামের এক ব্যক্তিকে, যিনি নিজেকে আহত দাবি করে সহায়তার জন্য এসেছিলেন।
জিয়াউল দাবি করেছিলেন, পায়ে আঘাত পাওয়ায় তার দুটি আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছে। পরে বেরিয়ে আসে, তিনি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। তখন তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পায়ে আন্দোলনে গিয়ে আবার আঘাত পান তিনি। যদিও ফাউন্ডেশন থেকে তাঁর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, দুর্ঘটনার পরপরই তাঁর পায়ের আঙুল কেটে ফেলা হয়েছিল।
প্রতারণার ঘটনায় রাজধানীর রমনা থানায় তিনটি মামলা করা হয়েছে। কারও কারও কাছ থেকে দায় স্বীকারের লিখিত বক্তব্য রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা ৫০টির মতো প্রতারণার ঘটনা পেয়েছেন।
সবচেয়ে বেশি প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে ঠাকুরগাঁও জেলায়। ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে পাঠানো ১৯৯টি আবেদনের নথির মধ্যে ১৫৬টি ভূঁয়া।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের তালিকায় নাম তোলার আগে যাচাই–বাছাই করে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে শহীদ হিসেবে ৮৩৪ জন এবং আহত ১২ হাজার ৪৯ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
ফাউন্ডেশন এ পর্যন্ত ৬৮৬ জন শহীদের পরিবারকে এবং ৩ হাজার ৭১৯ জন আহত ব্যক্তিকে সহায়তা দিয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ফুটপাতে চায়ের দোকান চালানো শফিকুল ইসলাম গত বছরের জানুয়ারিতে গাছ থেকে ফেলা ডাব ধরতে গিয়ে ডান হাতে ব্যথা পান। কিন্তু তিনিও আন্দোলনে আহত হয়েছেন বলে জুলাই ফাউন্ডেশনে অনুদানের জন্য আবেদন করেন। পরবর্তীতে যাচাই বাছাইয়ে ধরা পড়ে। বিষয়টি শফিকুল ইসলাম লিখিতভাবে স্বীকার করেন।
৪০ বছর বয়সী শাহিদা বেগম নামের এক নারী গত ৯ মার্চ ফাউন্ডেশনে গিয়ে সহায়তার টাকার জন্য চোটপাট শুরু করেন। ঘটনাস্থলে দেখা যায়, তিনি দাবি করছিলেন আন্দোলনে গিয়ে তাঁর দুই হাঁটুতেই গুলি লেগেছিল। রক্তাক্ত হাঁটুর ছবিও দেন। তবে তথ্য যাচাইয়ের এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন, গুলি লাগেনি, তিনি পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন।
তার দাবি, তিনি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। শিক্ষার্থী ও জনতার মধ্যে থাকা অবস্থায় নিজের একটি ভিডিও চিত্রও দেখান । তবে আন্দোলনেই আহত হয়েছেন, সে প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি।
নয়ন সিকদার নামের এক ব্যক্তিও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত দাবি করে সহায়তার জন্য ফাউন্ডেশনে গিয়েছিলেন। তিনি নিজে হাসপাতালে ভর্তি থাকার যে ছবি জমা দেন, সেটি ফটোশপে এডিট করা। তিনি গাজীপুরে একটি দোকানে কাজ করেন। ভুঁয়া কাগজপত্রের সঙ্গে আবেদন বিশ্বাসযোগ্য করতে ছবিটি দিয়েছিলেন।
সাভারের সাহিল খান নামের এক ব্যক্তি আহত না হয়েও অনুদানের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তদন্তে ধরা পড়ে যান। গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি লিখিত বক্তব্যে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
পাবনার চামেলী বেগম নামের এক নারী ১৬ বছর বয়সী ভাইকে আন্দোলনে আহত সাজিয়ে ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকার অনুদান নেন। পরে প্রতারণা শনাক্ত হয়। চামেলী লিখিতভাবে টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।
প্রতারণার অভিযোগে রমনা মডেল থানায় ১৩ই ফেব্রুয়ারি একটি মামলা করেছে ফাউন্ডেশন। মামলায় নারায়ণগঞ্জের মাসুম হোসেন প্রকাশ ইমন ও অজ্ঞাতনামা চার–পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, মাসুম আন্দোলনে আহত হননি এমন ব্যক্তিদের এমআইএস এ নাম অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করতেন। সাজানো ভুক্তভোগী এক লাখ টাকা পেলে মাসুম নিতেন ৫০ হাজার টাকা।
এর আগে ১০ই ফেব্রুয়ারি রমনা থানায় রাঙামাটির জুনায়েদ আহম্মেদ ও ভোলার আবুল কালামের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে আরেকটি মামলা করে ফাউন্ডেশন। আবুল কালাম নিজের ছেলেকে আহত দেখিয়ে এক লাখ টাকা সহায়তা নিয়েছেন। পরে ফাউন্ডেশন জানতে পারে, তাঁর ছেলে আন্দোলনে আহত হননি। আবুল কালামও প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তাঁকে সহায়তা করেছেন জুনায়েদ। ১ লাখ টাকার মধ্যে জুনায়েদ নেন ৩০ হাজার টাকা।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জুলাই শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ’র ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেছেন, নিয়মিতই জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা শনাক্ত হচ্ছে। যাচাই–বাছাই করে আন্দোলনে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের তালিকা করা গেলে কেউ প্রতারণা করার সুযোগ পাবে না।
শামীমা চৌধুরী শাম্মী