।।মনির ফয়সাল।।
করোনার মহামারী সংকট কাটতে না কাটতে অস্থির হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের চাল ও তেলের বাজার। এই যেন সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর ‘মরার ওপর খারার ঘা’হিসাবে দেখা দিয়েছে। এতে সীমিত আয়ের লোকজনের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্যমতে এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ এবং খোলা ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে গত সপ্তাহে যে চালের কেজি ছিল ৫৫ টাকা, এখন সেই একই চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি ৬০ টাকা, নাজিরশাইল ৬২ টাকা, বিআর-২৮; ৪৮ টাকা, পাইজাম ৫৮ টাকা, স্বর্ণা ৪৬ টাকা, জিরাশাইল ৫৫ টাকা। যা খুচরা পর্যায়ে আরও কয়েক টাকা বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারদের কাছ থেকে চড়া দামে কিনে কম দামে বিক্রির সুযোগ নেই। সরবরাহ স্বাভাবিক হলেই কেবল দাম কমবে। আর ক্রেতাদের বরাবরের মতো দাবি সিন্ডিকেটের কারসাজি। তারা বলছেন, প্রশাসন কড়া নজরদারি করলে ভাঙবে সিন্ডিকেট। কমে আসবে চালের দাম।
টিসিবি’র তথ্যমতে, ২০২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি খুচরা বাজারে সরু চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৪ থেকে ৬০ টাকা। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি তা বিক্রি হয়েছে ৫৮ থেকে ৬২ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ৫.২৬ শতাংশ। ২০২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মাঝারি চাল বিক্রি হয়েছিল ৪৪ থেকে ৫০ টাকায়। ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ৫২ থেকে ৫৮ টাকায়। বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১৭.০২ শতাংশ। একই সময়ে মোটা চাল বিক্রি হয়েছিল ৩২ থেকে ৩৬ টাকায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ৪৪ থেকে ৪৮ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৫.২৯ শতাংশ।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দীন বলেন, চালের বাজারে অস্থিরতার পেছনে উত্তরবঙ্গের চাল মজুতকারী মিল মালিকদের কারসাজি রয়েছে। সুতরাং, চালের দাম তো কমছেই না, বরং আরও বাড়বে। এর পেছনে চাল মজুতকারী মিল মালিকরা দায়ী। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। চালের বাজার এখন তাদের ইচ্ছেতেই চলছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ১ জুলাই সরকারের হাতে খাদ্য মজুদ ছিল ১৬ দশমিক ৭৪ লাখটন। ২০২০ সালের জুলাইয়ে খাদ্য মজুদ ছিল ১১ দশমিক ৮৮ লাখ টন। তবে বর্তমানে (২৫ জানুয়ারি ২০২১ সাল) পর্যন্ত সরকারি খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে ৭ দশমিক ৪ লাখ টন। এর মধ্যে চাল রয়েছে ৫ লাখ ৪৮ হাজার টন এবং গমের মজুদ এক লাখ ৫৬ হাজার টন। আমদানির পাশাপাশি সরকার ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রমও জোরদার রেখেছে। চলতি আমন সংগ্রহ (২০২০ সালের ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া) চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি সর্বমোট ৫১ হাজার ২৬ টন ধান-চাল সংগ্রহ হয়েছে। তবে আমন মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ টন। জানুয়ারির শুরুর দিকে দুই দফায় ১৭৭ টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৭৬ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু গত এক মাসে সরকারি ও বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ টন। এর মধ্যে বেসরকারিভাবে গত ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি হিলি স্থল বন্দর দিয়ে চার দফায় দুই হাজার ১৫৩ টন চাল আমদানি হয়।
চট্টগ্রাম জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু নঈম মোহাম্মদ সফিউল আলম বলেন, সরকারিভাবে আমদানি করা চালের প্রথম প্যাকেজের সাড়ে ৩১ হাজার মেট্রিক টক চাল চট্টগ্রামে এসেছে। বাকি সাড়ে ১৮ হাজার মেট্রিক টন চাল মংলা বন্দর দিয়ে নেমেছে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে বেসরকারিভাবে আমদানি করা চাল এখনও আসেনি। সরকারিভাবে আমদানি করা চাল সরকারি খাদ্য গুদামে রয়েছে।
চট্টগ্রামের চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, বছরের শুরুতে চালের দাম বাড়তে শুরু করে তবে আমদানি করার খবরে কিছুটা কমেছিল। কিন্তু আমদানি জটিলার আশঙ্কায় আবারও চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে চালের দাম কমানোর কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আগামী দুই মাস পর বাজারে নতুন চাল আসবে তখন দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার যে চাল আমদানি করেছে সেটা তাদের গুদামে মজুদ করছে। সরকারি আমদানি করা চালে বাজারে দাম কমবে না। কিন্তু দাম কমাতে হলে ব্যক্তি পর্যায়ে এলসির অনুমতি দিতে হবে। অন্যথায় বাজারে চালের দাম কমবে না। আর মোটা চালের উপর শুল্ক কমিয়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানির জন্য যে অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেখানেও নানা শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। শর্তের বেড়াজালে অনেকেই অনুমোদন নিয়েও চাল আমদানি করতে পারেনি। চাল আমদানির অনুমতি উন্মুক্ত করে দিলে দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসত। যে যার সামর্থ অনুযায়ী আমদানি করলে প্রতিযোগিতার কারণে দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকতো।
অন্যদিকে বাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম। লিটার প্রতি ভোজ্য তেলটি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। অথচ গত সপ্তাহেও এর দাম ছিল লিটারে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা। বিক্রেতাদের দাবি, সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি নগরীর ভোগ্যপণ্যের বাজার। তারাই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাড়াচ্ছে পণ্যের দাম।
টিসিবি’র তথ্যমতে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ থেকে ১১৮ টাকায়। গত বছরের এই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৮৮ থেকে ৯২ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে এই তেলের দাম বেড়েছে ২৮.৮৯ শতাংশ। বোতলজাত সয়াবিন তেল (৫ লিটার) গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছি ৪৭০ থেকে ৫২০ টাকায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ৫৭০ থেকে ৬২৯ টাকায়। দাম বেড়েছে ২০.২০ শতাংশ। এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছিল ১০৫ থেকে ১১৫ টাকায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়। দাম বেড়েছে ২০.৪৫ শতাংশ। গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি খোলা পাম তেল বিক্রি হয়েছিল লিটার ৭০ থেকে ৮২ টাকায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ৯৭ থেকে ১০০ টাকায়। দাম বেড়েছে ২৯.৬১ শতাংশ। গত বছরের একই তারিখে সুপার পাম অয়েল বিক্রি হয়েছিল ৮২ থেকে ৮৬ টাকায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিক্রি হয়েছে ১০২ থেকে ১০৫ টাকায়। দাম বেড়েছে ২৩.২১ শতাংশ।
জানা যায়, ২০২০ সালের জুলাই মাসে সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে প্রতিমণ ৩ হাজার ২০০ টাকায়। গত ২০ দিন আগে তা সাড়ে চার হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকে। গত সপ্তাহে তা চার হাজার টাকা নেমে এলও গতকাল আবারো বেড়ে ৪ হাজার ৪৪০ টাকায় উঠে যায়। গত জুলাইয়ে পাম অয়েলের মণ ছিল ২ হাজার ২৫০ টাকা। ২০ দিন আগে তা ৩ হাজার ৯০০ টাকায় উঠে যায়। গত সপ্তাহে তা ৩ হাজার ৩০০ টাকায় নেমে আসে। এই সপ্তাহে তা ফের বেড়ে ৩ হাজার ৫৫০ টাকা হয়েছে।
ভোজ্যতেলের পাইকারি ব্যবসায়ী আলমগীর পারভেজ জানান, গত জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন ভোজ্যতেল বিক্রি হয়েছিল ৫২৫ থেকে ৫৩০ ডলারে। এখন তা হাজার ডলারের কাছাকাছি দামে বিক্রি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ভোজ্যতেল ও চালের বাজার বেশ কয়েকমাস ধরেই অস্থির। ভোজ্যতেলের বাজার গুটিকয়েক বড় ব্যবসায়ীদের দখলে আর চালের বাজার পুরোটাই মিলমালিকদের কাছে জিম্মি। সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানি করার অনুমতি দিয়েছে মিলমালিকদের। তারা চাল এনে তাদের গুদামে মজুত করছেন। আর সরকার এখানে পুরোপুরি নীবর দর্শক।
তিনি বলেন, ক্যাব থেকে সংকটকালীন সময়ে খাদ্য বিভাগের আওতায় ওএমএস চালু করা, টিসিবির মাধ্যমে চাল ও ভোজ্যতেল বিক্রির দাবি করা হলেও সংকটকালিন সময়ে টিসিবি নিস্ক্রিয় এবং তাদের পণ্য তালিকায় আর চাল ও ভোজ্যতেল নাই। আছে পঁচা পেয়াঁজ। একারণে খেটে খাওয়া মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। যতদিন না প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে উদ্দেশ্য করে সরকারী বিধিবিধান ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে না, ততদিন সমস্যার উত্তরণ ঘটবে না।
বিএনএনিউজ/এসজিএন