বিএনএ, ঢাকা: সরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণকারীদের ২২.২ শতাংশ কোভিড রোগী বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এমন দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি।
মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসন: অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি এই তথ্য জানায়।
টিআইবি জানায়, করোনাকালে সরকার বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ও টিকা কার্যক্রম এবং করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গৃহীত প্রণোদনা কার্যক্রমে এখনো নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সুশাসনের বিশেষত অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে।
টিআইবি’র দাবি, নিজ জেলায় আইসিইউ সুবিধা না থাকায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে ১৮.৯ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অন্য জেলা থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। ৫.৪ শতাংশ সেবাগ্রহীতা হাসপাতালে শয্যা না পাওয়ায় বাড়িতে চিকিৎসা গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর শয্যা পেতে সেবাগ্রহীতাদের গড়ে সাড়ে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সেবাগ্রহীতাদের ১৪.১ শতাংশ অনিয়মিতভাবে চিকিৎসকের সেবা পেয়েছেন, ১৪.৯ শতাংশের অক্সিজেন পেতে বিলম্ব হয়েছে, ১.৭ শতাংশের প্রয়োজন থাকলেও হাসপাতালে একবারও অক্সিজেন পাননি, ১৫ শতাংশ তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে ভেন্টিলেশন সুবিধা পাননি, ১৩.৮ শতাংশ যথাসময়ে আইসিইউ সেবা পাননি এবং ৯ শতাংশ হাসপাতালে চিকিৎসাকালীন সময়ে একবারও আইসিইউ সেবা পাননি। সেবাগ্রহীতাদের তথ্যানুযায়ী, যথাসময়ে সেবা না পাওয়ায় হাসপাতাল থেকে সেবা নেওয়া ব্যক্তিদের ৭.৮ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু হয়েছে এবং ১১.৮ শতাংশ ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ ছাড়া, সরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণকারীদের ২২.২ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। টিআইবি’র জরিপ অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে ১২.২ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে ৪০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ম-বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়েছে।
টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড-১৯ সংক্রমণের ২ বছরে পরীক্ষাগার ও আইসিইউ শয্যার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও তা অল্প কিছু জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখনো ৩৪টি জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষার সুবিধা নেই। ২০২০ সালের জুন মাসে সরকার থেকে সবগুলো জেলা হাসপাতালে ১০টি করে আইসিইউ শয্যা স্থাপনের ঘোষণা করা হলেও এখনো ৩১টি জেলা হাসপাতালে এখনো আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়নি।
এদিকে ২০২১ সালের জুন মাসের পর আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ৯৪টি বৃদ্ধি পেলেও অধিকাংশই শহরকেন্দ্রিক এবং বেসরকারি। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকার কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের আওতায় জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, নমুনা পরীক্ষাগার স্থাপন, টিকা ও বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় করার কথা থাকলেও প্রায় ২ বছর পর তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি, কোভিড মোকাবিলায় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অনুদানের মাত্র ৬.৭ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে।
এ ছাড়া টিকা গ্রহণের সময় ১৫.৬ শতাংশ টিকাগ্রহীতা টিকা কেন্দ্রে অব্যবস্থাপনার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে টিকা কেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত না করা (৮১.৩ শতাংশ), টিকাকেন্দ্রে দীর্ঘ সিরিয়াল (৫৮.২ শতাংশ), অপেক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা (৪৩.৩ শতাংশ), ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা না থাকা (৩১.৬ শতাংশ), বয়স্ক বা প্রতিবন্ধিবান্ধব পরিবেশ না থাকা (২৯.৯ শতাংশ), টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ কক্ষ না থাকা (২৪.১ শতাংশ), নোংরা পরিবেশ (১৫.১ শতাংশ), টিকা কর্মীদের দক্ষতায় ঘাটতি (১৪,২ শতাংশ), সব বুথ খোলা না থাকা (১০.৪ শতাংশ) ইত্যাদি।
অন্যদিকে ২ শতাংশ টিকাগ্রহীতা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হন যার মধ্যে সময়ক্ষেপন, টিকাকেন্দ্রে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ও সরকারি কর্মকর্তাদের সুবিধা দেওয়া, দুর্ব্যবহার, এবং কিছু কেন্দ্রে টিকা থাকা সত্ত্বেও টিকাগ্রহীতাদের ফিরিয়ে দেওয়া অন্যতম। অতিরিক্ত ভিড় এড়িয়ে যথাসময়ে বা দ্রুত টিকা পেতে ১০.১ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে গড়ে ৬৯ টাকা ঘুষ হিসেবে দিতে হয়েছে বলে জরিপে উঠে এসেছে।
এছাড়া প্রবাসীরা টিকার নিবন্ধনের জন্য বিএমইটি নম্বর পেতে ১৫০-২০০ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে টিকা না নিয়েও টাকার বিনিময়ে প্রবাসীরা টিকা সনদ সংগ্রহ করেছেন। এমনকি টাকার বিনিময়ে টিকা করা একটি গ্রুপ ফেসবুক পেজে প্রবাসীদের চাহিদা অনুযায়ী টিকা বা সার্টিফিকেট প্রদানের বিষয়ে প্রচার করতে দেখা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরামের তত্ত্বাবধানে প্রণীত গবেষণাটি উপস্থাপন করেন একই বিভাগের রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন ও রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কাওসার আহমেদ। গবেষক দলের অপর সদস্য হলেন একই বিভাগের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট রাবেয়া আক্তার কনিকা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সমন্বয়ক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
বিএনএ/ এ আর