বিএনএ, ডেস্ক : ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকার একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। যা মজিদ খানের শিক্ষানীতি হিসাবে পরিচিত। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি উক্ত শিক্ষানীতি বাতিল, সব ছাত্র ও রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তি এবং সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠা, এই তিন দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে। পরে সচিবালয়ের অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।

মিছিলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস, জলকামান ও গুলি বর্ষণ করে। যার ফলে জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব, কাঞ্চন, দিপালীসহ অন্তত: ১০ জন শিক্ষার্থী নিহত হন এবং অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত ও গ্রেপ্তারের শিকার হন। আন্দোলনের মুখে পরবর্তীতে শিক্ষানীতিটি স্থগিত করা হয়।
পরবর্তীতে ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবছর স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস পালন হয়ে আসছিলো। কিন্তু ১৯৯৩ সাল থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে ‘ভেলেন্টাইন ডে’র আবির্ভাব ঘটান ‘যায় যায় দিন’ পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমান। এ কারণে শফিক রেহমানকে বাংলাদেশে ভালবাসা দিবসের জনক বলা হয়।
জানা যায়, এক সময় তেজগাঁওয়ের যায় যায় দিন পত্রিকা অফিসে কেউ চাকুরীর জন্য গেলে তাকে সাথে করে তার মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে যেতে হতো। তিনি তার অফিসের সামনে সড়কটিরও নামকরণ করেন লাভলেন।
তিনি লন্ডনে পড়াশুনার সুবাদে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে পরিচিত ছিলেন। তিনি যায় যায় দিন পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্ব ভালবাসা দিবস বাংলাদেশী মানুষের কাছে তুলে ধরেন। বিভিন্ন টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তার প্রচারণার কারণে এবং বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশে এ দিবসটি জনপ্রিয় হয়। ফলে ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস চাপা পড়ে যায়।
বাংলাদেশে‘ভেলেন্টাইন ডে’ বা ভালোবাসা দিবস পালন নিয়ে নানামূখী বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের কেউ কেউ মনে করেন, এ দিনটি উদ্যাপন করা সংস্কৃতি এবং ইসলাম ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়।
এদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ভালোবাসা দিবস উদ্যাপন নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে দেওয়া ওই পোস্টে তিনি লেখেন, ‘জুলাই-আগস্ট শহীদ ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এ বছর যেন কোনো ভ্যালেন্টাইন দিবসের তামাশা না হয়।’
ফরিদা আখতারের এই মন্তব্য আসার পরই ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। তাঁর ওই পোস্টের সমালোচনা করে একের পর এক মন্তব্য আসতে শুরু করে। একপর্যায়ে ওই পোস্টের কমেন্ট অপশন বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর পোস্টে ৬৯৫টি মন্তব্য এসেছে। শেয়ার হয়েছে ১ হাজার ৬০০। প্রতিক্রিয়া মোট ৭ হাজার ৪০০। এর মধ্যে ‘হা হা’ প্রতিক্রিয়া ৫ হাজার ৭০০।
এই পোস্টের বিষয়ে ফরিদা আখতার বুধবার সকালে বলেছেন, এখানে সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এটি ছিল আমার একটি আহ্বান। একটি শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে এই অনুরোধ আমাকে করা হয়েছিল এবং এটি আমি ফিল করি। আমি মন থেকে ফিল করি, ভ্যালেন্টাইন দিবস আমাদের দেশের সংস্কৃতি নয়। ভালোবাসা দিবস আপনি সারা বছর করতে পারেন। ভ্যালেন্টাইন দিবস নিয়ে আগে থেকেই অনেক সমালোচনা ছিল। এটি আমি স্ট্রংলি ফিল করি, এটি আমাদের সংস্কৃতি নয়।’
ফরিদা আখতার আরও বলেন, ‘আমরা ফাল্গুন পালন করব, একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করব। কিন্তু এ বছরটা যেহেতু একটি বিশেষ পরিস্থিতি এবং সে পরিস্থিতি আনন্দের নয়, এতগুলো শহীদ ও আহত মানুষের কথা আমরা কোনোক্ষণেই ভুলতে পারি না।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, ‘এই দিনে অনেক কিছু অতিরিক্ত হয়। যেন তামাশা আকারে না করা হয়, তাই আমি আহ্বান জানিয়েছি।’
ফরিদা আখতারের পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় একটি মন্তব্য এসেছে এমন, ‘আপা, ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস বহুকাল আগে থেকেই। এবার ৪২ বছর হবে।
‘পুনশ্চ: আমার ভয় হচ্ছে আপা, আপনার এই কমেন্টের ফলে এক সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠী মব করার বৈধতা পেয়ে গেল। এখন কোনো মানুষ যদি তার সঙ্গীকে নিয়ে এই দিবসে ভালোবাসা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত করতে চায়, তাকে “জুলাই গণ–অভ্যুত্থানবিরোধী” বলে পেটানোর ঘটনা ঘটলে, সেই দায়টা কে নিবে?’
তাঁর মন্তব্যের মাধ্যমে এভাবে মবকে উসকানি দেওয়া হয় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ফরিদা আখতার বলেন, ‘এটার সঙ্গে উসকানির কী সম্পর্ক আছে। আমি তো শ্রদ্ধা জানাতে বলেছি। কারও ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি। আমার এই মন্তব্যের পর ওদের ওপর কি কেউ আক্রমণ করবে বলে আপনি মনে করছেন? বাংলাদেশকে অত খারাপ ভাবার তো কোনো অর্থ নেই। যদি মব উসকানি হয়, তবে যারা এই উসকানি দিবে, সেটা তাদের দায়দায়িত্ব।’
ওই ফেসবুক পোস্টে আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘কেউ যদি ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করতে চায় আর সরকার বা যেকোনো গোষ্ঠী যদি তাতে বাধা দেয়, সেটাও তো ফ্যাসিবাদী আচরণ আপা।’
আরেকেজন লিখেছেন, ‘জন্ম, মৃত্যু, বিপ্লব, আহত-নিহত হওয়া, সংঘাত, শোক ও আনন্দ—সবই জীবনের অংশ। প্রতিদিনই কেউ না কেউ স্বজন হারাচ্ছে। সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, ইউক্রেনে প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে। এ দেশেও প্রতিদিন শোক করবার মতো ঘটনা ঘটছে। তাই বলে জগতে কেউ আনন্দ করবে না? সারা জীবন কাঁদতে থাকব? শোক ও উদ্যাপন পাশাপাশি চলতে পারে বলে মনে করি। যার শোক করবার সে শোক করুক। যার আনন্দ করবার সে আনন্দ করুক। চাপিয়ে দেওয়া কেন?’
এসব মন্তব্য নিয়ে ফরিদা আখতার বলেছেন, আমি খুব অবাক হয়েছি যে মানুষ এত হীন চিন্তা করতে পারে। শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বললেও রিঅ্যাকশন হয়, এটি আমার ধারণার বাহিরে। এসব মন্তব্যের মাধ্যমে তারা জুলাই ও আগস্টের শহীদদের প্রতি অবমাননা করছে। আমি এখনো মনে করি, আমি যে কথা বলেছি, সেটার মধ্যে আমি আছি।’
অনেকে প্রশ্ন তুলেছে, বাংলাদেশে ভালবাসা দিবস বা ভেলেন্টাইন ডে’র আমদানিকারক যায় যায় দিন সম্পাদক শফিক রেহমান। বর্তমানে তিনি দেশে আছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কট্টর সমর্থক এই প্রবীন সাংবাদিক এবার ভেলেন্টাইন ডে পালন করবেন, নাকি স্থগিত করবেন?
বিএনএ নিউজ,শামীমা চৌধুরী শাম্মী/এইচমুন্নী