বিএনএ, ডেস্ক : গত ৫ আগষ্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হঠাৎ করে তৌহিদী জনতার নামে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠি সারাদেশে মাজার ভাঙ্গতে শুরু করে। দেশের ৯৫০টি মাজারের মধ্যে অন্তত: ৮০টি তারা ভেঙ্গে ফেলেছে। যারাই প্রতিবাদ করেছে তারাই ‘মব’ জাস্টিজের শিকার হয়েছে। অভিযোগ আছে, এই মাজার ভাঙ্গার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতি নির্ধারকদের অনেকের সম্মতি ছিল। ফলে স্থানীয় প্রশাসনও ছিল নিরব।

কিছুদিন আগে কথিত তৌহিদী জনতা রাজধানীর ফার্মগেইট এলাকার কুতুববাগ দরবারের ওরশে হামলা চালিয়ে তা পন্ড করে দেয় এবং গরু ছাগলসহ বিভিন্ন সামগ্রী লুট করে নেয়। তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠে, নারীদের ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ করার দাবি করে। ফুটবল মাঠে হামলা চালিয়ে দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেয়। শুধু খেলা বন্ধতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। খেলাকে কেন্দ্র করে এক জেলায় তৌহিদী জনতা ও আয়োজকদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়েছে এসব ঘটনা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু দৃশ্যত তার কোনো প্রমাণ মিলছে না। বরং, এ ধরনের ‘মবের’ ঘটনা ঘটেই চলেছে।
গত ৩রা নভেম্বর চট্টগ্রামের রেয়াজুদ্দিন বাজারে একটি শো-রুম উদ্বোধন করতে দেয়নি কথিত তৌহিদী জনতা। গত ২৫ জানুয়ারি কালিহাতি উপজেলার এলেঙ্গার টিন মার্কেটের শোরুমটির উদ্বোধন করার কথা ছিল চিত্র নায়িকা পরীমনির। কিন্তু তৌহিদী জনতা তার আগমন ঠেকানোর ঘোষণা দেন। এতে চাপের মুখে শোরুম কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠানটি স্থগিত করে।
গত ২৮ জানুয়ারি ঢাকার কামরাঙ্গীচরের সোনার থালা নামের একটি রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের। তবে স্থানীয়দের বাধার মুখে পুলিশের হস্তক্ষেপে অপুকে ছাড়াই রেস্টুরেন্টটির উদ্বোধন করা হয়েছে।
সর্বশেষ বই মেলায় লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বই বিক্রির অভিযোগে একটি প্রকাশনীতে হামলা করেছে তৌহিদী জনতা। হামলাকারিদের প্রতিরোধ কিংবা গ্রেপ্তার করতে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো হামলার শিকার ব্যক্তিকে আটক করে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ।
প্রশ্ন উঠেছে, এ ধরনের হামলায় আসলে জড়িত কারা? কেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।দেশে গত কয়েকমাস ধরে যে ধরনের মব সংস্কৃতি চলছে, তাতে অবধারিতভাবেই সমাজের অনেকেই সরকারকে দোষারোপ করছেন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন,” তৌহিদী জনতার নামে যে কাজগুলো হচ্ছে, তা বেআইনি। সরকারের দায়িত্ব বর্তায় মব থামানোর। প্রকাশ্যে এভাবে আইন ভাঙ্গা, এটা ‘রঙ সিগন্যাল’ দেবে। এতে আইনের অবনতি তো হবেই, অথরিটির প্রতি থাকা ভয় চলে যাবে। ভয় চলে গেলে শাসন করা মুশকিল হয়ে যাবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক সাইয়েদ আব্দুল্লাহ আল মারুফ বলেন, সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে যে তারা কী চায়। দেশে বর্তমানে যে ধরনের মব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা চলতে থাকলে “দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে। ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কেউ সামাল দিতে পারবে না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম বলেছেন, “ইসলাম নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে। তৌহিদী জনতার নাম করে যা করা হচ্ছে তা ইসলাম সম্মত না।”
অবশেষে কথিত তৌহিদী জনতার বিষয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের টনক নড়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বই মেলায় তসলিমা নাসরিনের বই বিক্রির স্টলে হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। নিন্দা জানিয়েছেন দেশের বুদ্ধিজীবি, লেখক, প্রকাশকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
এই অবস্থায় সোমবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এক বার্তায় বলেছেন, অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাহলে আপনাদেরও ডেভিল হিসাবে ট্রিট করা হবে। আজকের ঘটনার পর আর কোন অনুরোধ করা হবে না। আপনাদের কাজ না আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া।
কথিত আন্দোলন আর মবের মহড়া আমরা এখন থেকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করব। রাষ্ট্রকে অকার্যকর এবং ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হলে একবিন্দু ছাড় দেওয়া হবে না।
তৌহিদী জনতা! আপনারা দেড় দশক পরে শান্তিতে ধর্ম ও সংস্কৃতি পালনের সুযোগ পেয়েছেন। আপনাদের আহম্মকি কিংবা উগ্রতা আপনাদের সে শান্তি বিনষ্টের কারণ হতে যাচ্ছে।
জুলুম করা থেকে বিরত থাকেন, নাহলে আপনাদের উপর জুলুম অবধারিত হবে। লা তাযলিমুনা ওলা তুযলামুনা- যুলুম করবেন না, যুলুমের শিকার ও হবেন না। এটাই আপনাদের কাছে শেষ অনুরোধ—লিখেছেন মাহফুজ আলম।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের শৈথিল্যে’র সুযোগে কতিপয় ইসলামপন্থী দলের সমর্থনে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে দেশে ‘মবক্রেসি’ প্রতিষ্ঠায় তৎপর রয়েছে। এখনই এই ‘মবক্রেসি’র লাগাম টানতে না পারলে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ সর্ম্পকে ভুল বার্তা যাবে এবং একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
বিএন এ নিউজ,শামীমা চৌধুরী শাম্মী/এইচমুন্নী