চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিশনাল ডেপুটি কমিশনার (ক্রাইম) এর দায়িত্বরত মোহাম্মদ কামরুল হাসান নিজেই একজন ক্রিমিনাল। ১৯৮৯ সালের ১০ই জানুয়ারি পুলিশে উপ-পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেওয়া এই কর্মকর্তা সম্পদের দিক থেকে এখন অনেক মোটা তাজা। তার মতো সম্পদে মোটা তাজা পুলিশ চট্টগ্রামে মেট্টোপলিটন পুলিশে খুব কমই আছে! এডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসান শুধু নিজে মোটা হননি স্ত্রীকেও তার চেয়ে কয়েকগুণ মোটা তাজা করেছেন। এমন তথ্য পাওয়া গেছে দুর্নীতি দমন বিভাগের অনুসন্ধানে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা স্ত্রীকে বাড়ি গাড়ি ফ্ল্যাট ব্যাংক একাউন্টে কোটি কোটি টাকা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। সাগরে চলাচলকারি ৫টি লাইটারেজ জাহাজও কিনে দিয়েছেন। ৩৫ বছরের চাকুরি জীবনে তিনি দাপটের সঙ্গে অবৈধভাবে ঘুষ নিয়েছেন। পুলিশের চাকুরিটাই যেন কামরুল হাসানের কাছে আলাদিনের চেরাগ হয়ে ওঠে। পারস্য রূপকথায় আলাদিনের চেরাগে ঘষা দিয়ে হুকুম করলে যেমন চাহিবা মাত্র হাজির হয়, তেমনিভাবে ৩৫ বছর চাকুরি জীবনে মানুষকে ঘষা দিয়েই বাড়ি গাড়ি, জমি ফ্ল্যাট ও জাহাজের মালিক বনে গেছেন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি । দুর্নীতি দমন বিভাগ দেরিতে হলেও তার লুকানো সম্পদের সন্ধান পেয়েছে।
পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর পদে চাকুরি জীবন শুরু করা মোহাম্মদ কামরুল হাসানের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায়। ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রামের ৮টি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপালন করেন তিনি। মূলত ওই সময়েই বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে ওঠেন কামরুল। এরমধ্যে নিজের ও স্ত্রীর নামে করা ১৯ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিষয় প্রকাশ্যে এসেছে।
দুদক অনুসন্ধানে জানতে পারে কামরুল হাসানের ১২ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৬৯৫ টাকার স্থাবর ও ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৯ হাজার ২১৬ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।
এ ছাড়া একই সময়ে তার মোট ৭০ লাখ ২৮ হাজার ২৪১ টাকার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ১৪ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ১৫২ টাকার। উক্ত সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া গেছে ৪ কোটি ৮০ লাখ ৩২ হাজার ৮৭ টাকা। এক্ষেত্রে তার অর্জিত সম্পদের চেয়ে তার বৈধ আয়ের উৎস ৯ কোটি ৮৬ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ টাকা কম।
এ দিকে দৃশ্যত কোনো আয় না থাকলেও কামরুল হাসানের স্ত্রী সায়মা বেগমের ২ কোটি ৫৩ হাজার ২৪০ টাকার সম্পদ থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। সায়মা বেগমের আছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার স্থাবর ও ১ কোটি ৯৯ লাখ ২৮ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ। এ ছাড়া একই সময়ে তার মোট ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৫৫ টাকার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬২১ টাকা। ওই সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া যায় ৪০ লাখ ১৪ হাজার ৪৩৩ টাকা। অর্থাৎ তার নামে ১ কোটি ৬২ লাখ ৮৫ হাজার ১৮৮ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎস বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য রেকর্ডপত্রদৃষ্টে দেখা যায়।
দুদক সূত্রে জানা যায়, সিএমপি’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কামরুল হাসানের চট্টগ্রাম নগরের সবচেয়ে অভিজাত খুলশী আবাসিক এলাকায় ‘ফয়জুন ভিস্তা’ অ্যাপার্টমেন্টের অষ্টমতলায় সি-৭ নামে ২ হাজার ৫৭০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
সোয়া সাত লাখ টাকায় ফ্ল্যাট ও মাত্র ২৫ হাজার টাকায় পার্কিং স্পেস কিনেছেন আয়কর নথিতে দাবি করলেও খুলশীতে আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য তিন কোটি টাকারও বেশি।
চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম নাসিরাবাদে সাত শতক জমির উপর চারতলাবিশিষ্ট বাড়ি করেছেন কামরুল হাসান। জমিসহ এই ভবন নির্মাণে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা খরচ দেখালেও নাসিরাবাদ এলাকায় এক শতক ভূমিই এক কোটি টাকার বেশি মূল্যে কেনাবেচা হচ্ছে। সেই হিসাবে ভূমি ও ভবনের বাজারমূল্য কমপক্ষে ৮ কোটি টাকা।
ঢাকার সাভারে ১০৭ শতক জায়গার উপর সাভার সিটি সেন্টার নামে ১২ তলা ভবনের চারজন অংশীদারের একজন এডিসি কামরুল। সেখানে তিনি কাগজ-কলমে সাত কোটি ৫২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এ ভবনের বেজমেন্টে ৯০টি, প্রথমতলায় ১৪০টি, দ্বিতীয় তলায় ১৪৬টি, তৃতীয়তলায় ৮৯টি ও চতুর্থ তলায় ১০৩টি দোকান এবং ৫ হাজার বর্গফুটের ফুডকোর্ট, পঞ্চম তলায় অফিস ও ষষ্ঠতলায় ৬৭টি ফ্ল্যাট রয়েছে। বাজারমূল্যে এ সম্পদের মূল্য শতকোটি টাকারও বেশি। এদিকে সাভার সিটি টাওয়ার নামে একটি ১০ তলা আবাসিক ভবনেরও অংশীদার কামরুল। সেখানে ৫৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরের উত্তর হালিশহর, নাসিরাবাদ, চান্দগাঁও এলাকায় শতাধিক ফ্ল্যাট ও দোকান রয়েছে কামরুলের। চট্টগ্রাম ও ঢাকার সাভারে ১৫৪ শতক জমি ও দুটি বাড়ি রয়েছে তার। পাশাপাশি কামরুলের ব্যাংকে ১ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার বন্ড ও এফডিআর থাকার তথ্য উঠে এসেছে দুদকের অনুসন্ধানে।
এডিসি কামরুল হাসানের স্ত্রী সায়মার চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরে ৪০ শতক নাল জমি রয়েছে। যেগুলোর ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এযেন ১৬ শ শতাব্দির শায়েস্তা খানের আমল! খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান বাজারে ওই জমির মূল্য ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা।
কামরুল হাসান স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে সওদাগর নেভিগেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়েছেন। ডবলমুরিং থানার বারিক বিল্ডিং মোড এলাকার একটি বহুতল ভবনে এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। ৫টি লাইটারেজ জাহাজের মালিক কামরুলের স্ত্রী সায়মা বেগম। যা কামরুল হাসান উপহার হিসাবে স্ত্রীকে দিয়েছেন।
৪টি লাইটারেজ জাহাজে কাগজে কলমে সায়মার পুঁজি দেখানো হয়েছে মাত্র দেড় কোটি টাকা। তবে বাস্তবে এই ৪টি জাহাজের দাম অন্তত ২০ কোটি টাকা। এসব জাহাজ নাম ও রং বদল করে হস্তারের চেস্টা করা হচ্ছে বলে একটি সূত্র জানায়।এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে তার নামে ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে।
গত ৭ জুলাই দুদক চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত-১ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মো. এমরান হোসেন আদালতের কাছে পুলিশ কর্মকর্তা কামরুল হাসানের সম্পদ ক্রোকের আবেদন করেন। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ জেবুননেছা তা মঞ্জুর করেন।
বিএনএনিউজ /শামীমা চৌধুরী শাম্মীএইচমুন্নী