বিএনএ, বরিশাল: রাত পোহালেই ভোট বরিশাল সিটি করপোরেশন (বসিক) নির্বাচন। গতকাল শনিবার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে নির্বাচনী প্রচার। তবে এই নির্বাচনে এখন ভোটের চেয়ে রাজনীতির খেলা বেশি হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে মুখর ছিল নগরী। সকাল থেকেই গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করেন ৭ মেয়র প্রার্থীসহ ১৬৭ প্রার্থী। সব প্রার্থীর দাবি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিজয়ী হবেন।
শেষ দিনের গণসংযোগে নৌকা প্রতীকের আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ (খোকন সেরনিয়াবাত) বলেছেন, ‘আমাকে জামায়াত ভোট দেবে কিনা জানি না, তবে বিএনপি ভোট দেবে। আমি আমার বিজয় নিয়ে শতভাগ নিশ্চিত। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের উন্নয়নে কাজ করতে চাই।’
গণসংযোগকালে তিনি ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, ‘দীর্ঘদিন উন্নয়নবঞ্চিত বরিশালকে নতুনভাবে সাজানোর লক্ষ্যে নৌকা প্রতীককে ভোট দিয়ে বিজয়ী করতে হবে। এ নগরী একসময় উন্নয়নের উদাহরণ ছিল। প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবেও পরিচিত ছিল। গত ১০ বছরে এখানে দায়িত্বরত জনপ্রতিনিধিরা উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ সারা দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। তাই আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনা আমাকে বরিশালের উন্নয়ন করার দায়িত্ব দিয়ে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছেন। আপনারা নৌকায় ভোট দিয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করার সুযোগ করে দেবেন।’
নগরীর ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেন অন্তত দুজন। তাদের একজন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন দলটির মূল ঘাঁটি বরিশালে। বিএনপির প্রার্থী না থাকায় তাদের ভোটের একটি বড় অংশ পাবেন বলে আশা করছেন হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী। বিশেষ করে সরকারবিরোধী ভোটের একটি বড় অংশ হাতপাখায় পড়লে নৌকার প্রার্থীর জন্য পার পাওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা বলছেন, গত ৫ জুন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালক কমিটি প্রচারণা শুরু করার পর নৌকার ঐক্যে ওপর জোর দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে নৌকা তার মাঠ ফিরে পেতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, বরিশালে সিটি নির্বাচেন জন্য গত কয়েকদিন ভোটের মাঠে থেকে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল সিটি নির্বাচনে দলের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাড. আফজাল হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
বরিশাল আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা জানান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীকে তারা বড় বাধা হিসেবে দেখছেন। শেষ পর্যন্ত দলীয় দ্বন্দ্বের ছাপ ভোটের বাক্সে পড়লে তাদের নির্বাচনি বৈতরণী পার হয়ে আসা কঠিন হবে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
তবে খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, দলের মধ্যে কোন্দল আছে কী না জানি না। তবে আমরা প্রকাশ্যে কোনো কোন্দল দেখতে পাচ্ছি না। সবাই ঐক্যবদ্ধ। কেন্দ্রীয় নেতারাও কাজ করছেন। আমাদের ১২৬টি কেন্দ্র আছে সেই কেন্দ্রভিত্তিক কোনো কোন্দল নাই। যারা অতীতের নির্বাচনে এইসব কেন্দ্র পাহারা দিয়েছেন। কেন্দ্রে ভোটার নিয়েছেন তারা সবাই আমাদের সঙ্গে আছেন।
এই নেতা জোর দিয়ে বলেন, গাজীপুর আর বরিশাল এক নয়। এখানে বড় কোনো কোন্দল নেই।
জানা যায়, ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন পঞ্চম নির্বাচন। বিগত চারটি নির্বাচনের ফলাফলে দুই বার বিএনপি এবং দুই বার আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। যদিও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনেক এলাকায় ভোটকেন্দ্র দখল করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে সিল মারার অভিযোগ আনেন প্রতিদ্বন্দ্বী সব মেয়র প্রার্থী। এই অভিযোগের স্বপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে ভোট বর্জন করেন তারা। বিগত নির্বাচনের বাজে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এবারের নির্বাচনে অংশ নেননি বাসদের মেয়র প্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্তী। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে কারচুপির অনেক প্রমাণ গণমাধ্যমে তুলে ধরেন।
গত চারটি সিটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখানে বরাবরই বিএনপির ভোট অনেক বেশি। এ কারণে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীর মাঝেও বিএনপিকে জয়ী হতে দেখা গেছে। ইভিএমের কারণে গাজীপুরের মতো বরিশালেও এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলেই মনে করছেন বরিশালের ভোটাররা। তা ছাড়া সরকারের বর্তমান সার্বিক অবস্থা ও ইসির কঠোর মনোভাব দেখে ভোটারদের পাশাপাশি প্রার্থীরাও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে অনেকটাই আশাবাদী।
বরিশালে বাহ্যিকভাবে ভোটের মাঠে দ্বিতীয় অবস্থানে অর্থাৎ নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করা হয় ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখাকে। তারাও প্রচারণায় সরব ছিল। তাদের কর্মীরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নিঃস্বার্থভাবে দলের জন্য কাজ করছেন। কিন্তু প্রচার কাজে নিয়োজিতদের অনেকেই নগরীর ভোটার নন। কেন্দ্রসহ বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা, বিশেষ করে চরমোনাই মাদরাসা থেকে আসা কর্মীরাই মূলত তাদের প্রধান প্রচারকর্মী। বরিশালের চরমোনাই ইউনিয়নে ইসলামী আন্দোলনের ভোট ব্যাংক থাকলেও নগরীতে তাদের খুব বেশি রিজার্ভ ভোট নেই। এ কারণে তাদের প্রধান ভরসা বিএনপির ভোট ব্যাংক। তবে হাতপাখার মেয়রপ্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম বিএনপির নারী ভোটারদের বেশ কিছু ভোট পাবেন, কিন্তু বিএনপির পুরুষ ভোটারদের ভোট তেমন পাবেন না। কারণ সচেতন বিএনপি কর্মীরা ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে চরমোনাই ইউনিয়নে দলের বর্তমান যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারের উপর হামলার কথা এখনো ভুলতে পারেননি।
হাতপাখা প্রতীকের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রশাসন ভালো আছে। আমরা আশাবাদী, এভাবে চললে আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পাব। আমি নির্বাচনে বিজয়ী হব।’
জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের নেতা পর্যায়ের লোকেরা ভোট কেন্দ্রে যাবেন না, শুধু যেসব এলাকায় জামায়াতের কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচন করছেন সেখানে তারা কাউন্সিলর প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। মেয়র পদে তারা নৌকা ও হাত পাখাকে কোনো ভোট দিবেন না। সেক্ষেত্রে তাদের ভোট জাতীয় পার্টির ডানপন্থী প্রার্থী হিসেবে ইকবাল হোসেন তাপসের লাঙল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রুপনের টেবিল ঘড়ির দিকে যেতে পারে।
নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে পুরো সিটি করপোরেশন এলাকা। নির্বাচনী এলাকায় টহল দিচ্ছেন বিজিবি, র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ভোটগ্রহণের দিন নির্বাচনী এলাকার সব অফিস-আদালত, মিল-কারখানা, স্কুল-কলেজসহ সব প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, ৪ হাজার ৪০০ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৩০০ পুলিশ রয়েছে। এছাড়া ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পুলিশের হিসাবে ৭০টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রার্থীরা যেসব কেন্দ্র নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সেগুলো যুক্ত করে ১০৬টিকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়েছে।
বিসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, প্রথমবারের মতো এবার বরিশালের সবগুলো কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ হচ্ছে। ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিষয়ে প্রতীক বরাদ্দের পরই প্রতিটি ওয়ার্ডে একটানা ভোটারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এতে ভোটারদের মধ্যে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ব্যাপক সাড়ার কারণে নির্ধারিত সময়ের বেশি থেকেও প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে আমাদের। আশা করছি, কেন্দ্রে ভোটার সমাগম ঘটবে এবং সুষ্ঠু পরিবেশে তারা ভোটে দেবেন।
তিনি বলেন, নির্বাচনের নিরাপত্তায় ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবে। ১২৬ কেন্দ্রে সিসি টিভি কামেরা স্থাপনের কাজ শনিবারে শেষ করা হয়েছে। নির্বাচনে ৮৯৪টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণ করা হবে। প্রতিটি ভোটকক্ষে একটি করে এবং প্রতিটি কেন্দ্রের প্রবেশ পথে দুটি করে ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। এতে মোট ১ হাজার ১৪৬টি ক্যামেরা থাকবে।
প্রসঙ্গত, বসিক নির্বাচনে মোট ১৬৭ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে মেয়র পদে সাতজন, সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ১১৮ জন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৪২ জন। ৩০টি ওয়ার্ডে ১২৬টি কেন্দ্রের ৮৯৪ কক্ষে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। মোট ভোটার ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮০৯ জন এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৯ জন।
বিএনএ/এমএফ