।। মিজানুর রহমান মজুমদার।।
২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য ব্যাংকাররা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি। কারণ, বারবার পুনঃ তফসিল ও অবলোপন করে খেলাপি ঋণ গোপন করা হয়। আর অনেকে খেলাপি হয়ে পড়লেও তা হিসাবে দেখানো হয় না।
খেলাপি ঋণের কারণে ১২টি ব্যাংক চরম তারল্য সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় অনেকে নগদ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে। কিনছে জমি, ফ্ল্যাট, নগদ ডলার, সোনা।
এছাড়া হঠাৎ করে জমি, ফ্ল্যাট ও সোনা বিক্রি বেড়ে গেছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল, পায়রা বন্দর, কক্সবাজারের মাতারবাড়ি বিদ্যুত কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, টেকনাফসহ বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট এলাকায় বেসরকারী খাতে জমি কেনায় চলছে প্রতিযোগিতা।ফলে ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
এক শ্রেণির ব্যবসায়ি ও আমলারা সোনা ও ডলার কিনে মজুদ করছেন। সে কারণে ব্যাংক গুলোতে বড় লকারের চাহিদা বেড়ে চলেছে। অনেকে স্বনামে-বেনামে একাধিক বড় লকার ভাড়া নেয়ার হিড়িক পড়েছে। সরকারিভাবে যে ডলার ১০৬ টাকা সেখানে বেসরকারিভাবে বিক্রি হচ্ছে ১১৪/ ১৫ টাকা। যা অতীতে কখনো হয়নি।
দেশে ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠার পেছনে লকারে বিদেশী মুদ্রা রাখার প্রবণতাও এক প্রকার ভূমিকা রাখছে। ডলার, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র রাখার কারণেই ব্যাংকগুলোয় বড় লকারের চাহিদা বাড়ছে।
লকারে গ্রাহকরা কী রাখছেন, ব্যাংকের পক্ষে সেটি দেখা বা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। অনেক গ্রাহক সেবাটির অপব্যবহার করে ডলার ও সোনা কিনে মুজুদ করছেন। এতদিন দেশের ব্যাংকগুলোয় ছোট ও মাঝারি লকারের চাহিদা ছিল বেশি। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে এর বিপরীত চিত্র। গ্রাহকরা ব্যাংকের কাছে বড় লকার ভাড়া নিচ্ছেন।
ঢাকার গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা, মতিঝিল, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদসহ দেশের বিভাগীয় শহরে ব্যাংকের শাখাগুলোয় এখন বড় লকারের চাহিদা বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে লকার সেবার পরিধি বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছে ভাড়াও।
লকার সেবা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারিতে আনা জরুরি
লকারে কী আছে, সেটি অনুসন্ধান করতে চাইলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদালতের অনুমতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের উপস্থিতিতে লকার খুলতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরও (এনবিআর) এ ক্ষমতা থাকলে বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে না জড়ালে তারা লকার খুলে দেখার তাগিদ অনুভব করে না। শৃঙ্খলাহীনভাবে সম্প্রসারিত লকার সেবাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির আওতায় আনা জরুরি।
হঠাৎ সারা দেশে জমি কেনাবেচা আগের চেয়ে বেড়েছে। যে জমি ৬ মাস আগেও কেনার মতো ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি, সে জমিই আরও বেশি দামে বিক্রি হয়ে গেছে। জমি কেনাবেচা বাড়ার পেছনে মহল বিশেষের বিভিন্ন ধরনের গুজব ‘ব্যাংক খাতে একটি অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের আমানতে। গ্রাহকদের একাংশ এখন আমানত তুলে নিয়ে জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি কেনার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
সময় থাকতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে হবে
ফ্ল্যাট কেনার টাকার জন্য ব্যাংকগুলোতেও এখন প্রচুর ঋণ আবেদন জমা হচ্ছে । ব্যাংক গুলোও এখন বড় ঋণের চেয়ে ছোট ঋণের দিকে বেশী আগ্রহী। কেননা, ফ্ল্যাট এবং গাড়ির ঋণ আদায়ের হার প্রায় ৯৮ শতাংশ।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সানেম বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, সাধারণ মানুষ ব্যাংকে যে আমানত রাখছেন, তার একটা অংশ নিয়ে যাচ্ছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। নিয়ে তা ফেরতও দিচ্ছেন না। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা ব্যাংক খাতে একটা বড় সমস্যা। অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরও বলেন, বড় বড় ঋণখেলাপিরা মাত্র ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে খেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে নিচ্ছেন।
আরেক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া খেলাপি ঋণ কমবে না। এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বললেও কমবে না।
আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে, যাতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার শর্তও রয়েছে। আইএমএফ বলেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে রাখতে হবে। আর বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা রাখতে হবে ৫ শতাংশের নিচে। সুতারাং সময় থাকতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে হবে।