বিএনএ ডেস্ক :‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। ছোটগল্প নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই চরণের মতোই অবস্থা নিবন্ধনবিহীন সরকারি রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির। সমালোচকদের অনেকে এনসিপিকে ন্যাশনাল সার্কাস পার্টি নামে অভিহিত করে থাকেন। তারই প্রমাণ দেখা দেখা গেছে শেখ হাসিনা সরকার পতনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে রাষ্ট্রীয় উদযাপন বাদ দিয়ে শীর্ষস্থানীয় পাঁচ নেতার কক্সবাজারে ‘সমুদ্র বিলাশ-এর মাধ্যমে।
এনসিপি’র শীর্ষ এই নেতাদের এই সমুদ্র বিলাশের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে শেখ হাসিনা সরকার পতনের আর্ন্তজাতিক মাস্টারমাইন্ড ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নাম। যদিও পিটার হাসের সঙ্গে এনসিপির এই ৫ কেন্দ্রীয় নেতার বৈঠকের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জুলাই অভ্যুত্থানের গর্ভে জন্ম নেওয়া এ দলের কেউ কেউ মনে করছেন, পাঁচ নেতা যে কাজেই কক্সবাজারে গিয়ে থাকুক না কেন, তা দলের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহও তৈরি করেছে। রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে এনসিপি নেতাদের এমন অবকাশ সফরের বিষয়টিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা হিন্দু প্রবাদের আঙ্গিকে বলছেন “ডাল মে কুচ কালা হ্যায়”। যার বাংলা অর্থ “ডালে কালো কিছু আছে”। এই প্রবাদের মাধ্যমে বোঝানো হয় কোথাও কোনো সমস্যা বা সন্দেহজনক কিছু ঘটছে যা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছু একটা গোলমাল আছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এনসিপি’র এই ৫ নেতার কক্সবাজার সফরটিতে অতি গোপনীতা রক্ষা করা হয়। ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট যখন সাড়ে ১১ টার দিকে কক্সবাজার বিমান বন্দরে নামে, তখন তাদের মুখে ছিল মাস্ক। বিমান বন্দরের সামনের দিকে বের না হয়ে পিছন দিকে বের হন। এরপর বিমান বন্দর থেকে ২৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে উখিয়ায় টিউলিপ হোটেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত হোটেলটিতে তারা কোন বুকিং দেননি। তাছড়া বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য বিমানের টিকেটও বুকিং ছিল।
প্রশ্ন ওঠেছে, কাউকে না জানিয়ে এমন ‘গুরুত্বপূর্ণ দিবসে’ ঢাকার বাইরে যাওয়ায় এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ, তার স্ত্রী এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা, উত্তরাঞ্চল মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চল মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ এবং মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী যদি নিছক অবকাশ যাপন করতে যেতেন, তারা বিমানে ফিরতি বুকিং দিয়েছিল কেন?
এখানেই শেষ নয়, তারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করেনি। অথচ গত ১৯শে জুলাই কক্সবাজারে এক পথ সভায় বিএনএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিনের প্রতি ঈঙ্গিত করে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেছেন, কক্সবাজারে নব্য গডফাদার শিলং থেকে এসেছে। ঘের দখল করছে। মানুষের জায়গা জমি দখল করছে। চাঁদাবাজি করছে। তার এই বক্তব্যের জেরে চকরিয়া, ঈদগাওতে এনসিপির পথ সভার মঞ্চ ভাঙ্চুর হয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পহারায় সভা না করে বান্দরবানে চলে যেতে বাধ্য হয়। এই পরিস্থিতিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত না করে কেন সমুদ্র বিলাসে আসতে হলো?
৫ নেতার গোপন সফরের ওই খবর প্রচার হওয়ার পর টিউলিপ হোটেলের বাইরে বিক্ষোভ করে স্থানীয় বিএনপি। পুলিশ এবং র্যাব ঘটনাস্থলে না এলে ‘মব ভায়েলেন্স’ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন “পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকের খবরটি সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, গোয়েন্দা সংস্থা হোক আর গণমাধ্যম হোক, খবরে না এলে কেউ জানতো না এনসিপির এসব গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কেন হঠাৎ কক্সবাজার সমুদ্র বিলাসের শখ উঠেছে?। সুতরাং তাদের চলাফেরার মধ্যে সন্দেহ করার মত কিছু আছে। “পিটার হাস না হলেও অন্য কোনো বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে নিশ্চয়ই তারা দেখা করেছেন বা দেখা করার কথা ছিল!
সূত্র জানিয়েছে, ৬ ই আগষ্ট দুপুর ১টার দিকে কক্সবাজার শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরের ইনানীর জালিয়াপালং এলাকার হোটেল ‘সি পার্ল রিসোর্ট’ ত্যাগ করেন পাঁচ নেতা। কক্সবাজার শহরে পৌঁছে তারা কলাতলীর শালিক রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে, সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে অবস্থিত ‘প্রাসাদ প্যারাডাইজ’ হোটেলে ওঠেন এনসিপি নেতারা।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, “এনসিপি নেতারা আসবেন, এ বিষয়টি পুলিশ অবগত ছিল না। তবে যখন থেকে তারা কক্সবাজার এসেছেন, তখন থেকে তাদের প্রতি বিশেষ নজরদারি রয়েছে।”
এনসিপি’র শীর্ষ সারির ৫ নেতার জ্ঞানহীন সমুদ্র বিলাস কান্ডে দলটি এতটাই বিব্রতকর ও নাজুক অবস্থায় পড়েছে যে, তাদেরকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে কারণ দর্শা নোটিশ জারি করতে হয়েছে। যদিও তারা কেউ ২৪ ঘন্টার মধ্য এর জবাব দেয়নি।
তিনদিন পর হাসনাত আব্দুল্লাহ ও নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী এর জবাব দিয়েছে। দুইজনের দীর্ঘ জবাবের সারমর্ম হচ্ছে, জুলাই সনদে তাদের মতামতের প্রতিফলন হয়নি, অনুষ্ঠানে তাদের দাওয়াত দেয়া হয়নি। গ্লানি- ক্লান্তি দূর করতে এবং অসন্পূর্ণ জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রতি নিরব প্রতিবাদ জানাতে এবং বিষয়গুলো সাগরপাড়ে বসে গভীরভাবে ভাবতেই কক্সবাজার সমুদ্র ভ্রমণে গেছেন। তবে হাসনাত-পাটোয়ারী দুইজনই জানিয়েছেন তাদের সমুদ্র যাত্রার বিষয়টি দলের আহবায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছিলেন।
প্রশ্ন ওঠেছে, তাহলে পাঁচ নেতার কারণ দর্শানোর নোটিশে কেন উল্লেখ করা হয়েছে, দলকে না জানিয়ে তারা কক্সবাজার গেছেন? তাহলে কী সরকারের চাপে পড়ে, ‘আই ওয়াশ’ করয়েই এই কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে কি না— সেই প্রশ্নও এখন সামনে এসেছে।
এছাড়া এনসিপির ৫ নেতার সমুদ্র বিলাসের ঘটনা এবং তাদের ব্যক্তিগত চলাফেরার ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার প্রসঙ্গ ধরে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেছেন, “অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ ধরনের কাজে সাধারণত গোয়েন্দা সংস্থাই যুক্ত থাকে। তবে সামান্তা এটিও বলেছেন, “যত বড় নেতাই হোক, যত জনপ্রিয় নেতাই হোক, তার আচরণগত কোনো ত্রুটি হলে আমরা ছাড় দেব না।
জনমনে প্রশ্ন রয়েছে, সরকার কী এখন এনসিপিকে বোঝা মনে করছে? তাদের দৌরাত্বের লাগাম টানতে চায়?
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলছেন, “ঘটনা কী ঘটেছে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। দলের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে নিষেধ রয়েছে।
এদিকে এনসিপি’র উত্তরাঞ্চল মূখ্য সংগঠক সারজিস আলমের সূর্যাস্তের আগে সমুদ্র সৈকত থেকে ফেইসবুক লাইভ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। দলের ২১ নম্বর ইশতেহারের উল্লেখ করে বলেছেন “আমরা কক্সবাজারে লক্ষ্য করেছি, ব্যবস্থাপনা ছাড়াই যেখানে-সেখানে দালান তৈরি করা হচ্ছে; যেখানে-সেখানে মানুষ জমি দখল করছে। এসব অব্যবস্থাপনার কারণে গ্লোবাল ওয়ার্মিং তৈরি হচ্ছে। তাই পরিবেশ, সম্পদ ও জলবায়ু নিয়ে সচেতন হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” তবে এ সময় তিনি কক্সবাজার সফর নিয়ে কিছু বলেননি।
সারজিসের এমন সমুদ্র লাইভ দেখে কেউ কেউ এটিকে ‘সার্কাস’ নামে অভিহিত করে মন্তব্য করেছেন, এনসিপি কী সমুদ্র পাহারার দায়িত্ব নিয়েছেন?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই আন্দোলনের সম্মুখ যোদ্ধা, ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠনে আগ্রহী ছিলেন না। তারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিয়ে ‘প্রেসার গ্রুপ হিসাবে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইচ্ছা ও আবদারে তারা জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি গঠন করেছে। দলের নামটিও তার দেয়া।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করার সাফল্য ছাড়া প্রতিষ্ঠার ৬ মাসে এনসিপি জনগণকে তেমন কোন চমক দেখাতে পারেনি। জুলাই আন্দোলনের অংশিদার বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীর সমালোচনা করে জনগণের আস্থা অর্জন করার যে চেষ্টা করেছিল —তা হালে পানি পায়নি।
তাছাড়া গোয়েন্দা জরিপে দেখা গেছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এককভাবে একটি আসনেও জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই অবস্থায় অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য এনসিপি বোঝা হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে গোপালগঞ্জে তাদের নিরাপত্তা দিতে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৫ জনের মৃত্যু এবং ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ভাঙ্গার ঘটনায় দেশ-বিদেশে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের ভাবমূর্তির ধস নেমেছে। এমনকি সরকারি দল খ্যাত এনসিপি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আস্থাভাজন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমকে নিয়ে বিদ্রুপমূলক কড়া সমালোচনা ও পদত্যাগ দাবি সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। সবমিলিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এনসিপি’র ‘জাতীয় সার্কাস’ বন্ধ করতে চায় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনএ/ সৈয়দ সাকিব