।। এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন ।।
বিএনএ, কক্সবাজার: পর্যটন নগরী কক্সবাজারের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর মেরিন ড্রাইভস্থ রামুর পেঁচারদ্বীপের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংস ও ভরাট খাল দখল করে ক্ষমতার দাপটে অবৈধ রিসোর্ট নির্মাণ করছে মারমেইড কর্তৃপক্ষ।
সাগরপাড়ের সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ানের ৫০০ নম্বর দাগের বিশাল এলাকা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে যাচ্ছে। স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংস করে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হচ্ছে। নির্বিচারে কাটা হয়েছে বাইন, কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার গাছ। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে প্যারাবনের জীববৈচিত্র্যসহ পাখির আবাসস্থল। ইতিমধ্যে ম্যানগ্রোভ দখল করে দেয়া হয়েছে সীমানা পিলার ও ঘেরা। নির্মাণ করা হয়েছে ৫ শত ফুটের বিশাল লম্বা কাঠের সাঁকো। এভাবে একরের পর একর প্যারাবন জবরদখল ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে।
স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালীর সহযোগিতায় মারমেইড কর্তৃপক্ষ সাগরপাড়ের সরকারি জমি জবরদখল করলেও প্রশাসন নিরব ভূমিকায় রয়েছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় এসব জীববৈচিত্র্য বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চালানো হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাসহ পরিবেশবাদীরা।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানিয়েছেন, মেরিন ড্রাইভ সড়কের পশ্চিমে পেঁচারদ্বীপের আবাহানা ও জাদুঘর এলাকার পশ্চিম পাশে ছিল বিশাল চর ও রেজু নদীর অংশ। কালের পরিক্রমায় রেজু নদীর এ অংশ আস্তে আস্তে ভরাট খালে পরিণত হয়। এ খাল থেকে এক সময় স্থানীয়রা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। এই চর ও ভরাখালে প্রায় ২০ বছর পূর্বে প্যারাবন সৃজন করেছিল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নেকম। পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবেও প্যারাবন সৃজন হয়। ওই এলাকায় ঘন প্যারাবন, খালের জোয়ার-ভাটা, জীববৈচিত্র্য ও পাখির আবাসস্থলে পরিণত হয়েছিল। জায়গাটি সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভূক্ত খাল ও চর শ্রেণীর। এর পশ্চিম পাশে রয়েছে ঝাউবন। কিন্তু এখন ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দাবী করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সহযোগিতায় প্যারাবন কেটে জবরদখল শুরু করে মারমেইডের মালিক সোহাগ ও তার ভাই শাহিন। প্যারাবনের গাছ ও ঝাউগাছ কেটে তারা বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করছে বলেও জানান স্থানীয়রা।
শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেরিন ড্রাইভ সড়কের পশ্চিম পাশে পেঁচারদ্বীপের আবাহানা এলাকায় ক্যাম্প-ইন কক্স নামের রয়েছে মারমেইড কর্তৃপক্ষের রিসোর্ট। এর পশ্চিমে বিশাল চর, প্যারাবন ও ভরাট খাল। যেখানে প্রতিদিনই আসে জোয়ারের পানি। এ বিশাল চর ও খালে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৫০০ ফুট লম্বা কাঠের সাঁকো। স্কেভেটর দিয়ে কাটা হচ্ছে মাটি। নির্মাণ করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা। কাটা হচ্ছে প্যারাবন ও ঝাউগাছ। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে গাছের ঢালপালা। প্যারাবনের গাছ ও ঝাউগাছ দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে কটেজ। প্যারাবনের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে রেস্টুরেন্ট। এভাবে প্যারাবনে ধংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। এতে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মারমেইডের জমি দেখাশুনার দ্বায়িত্বে থাকা সৈয়দ আলম সুলতান বলেন, জমিটি খাস খতিয়ানের ঠিকই। কিন্তু আরএস ৬৫ ও ৪৩ খতিয়ানের ২ একর ২৪ শতক জমির নথিমূলে মালিক মরহুম গোলাম বারীর ৫ পুত্র ও ৩ কন্যা বিএস সংশোধনে ২৪১ নম্বর মামলা দায়ের করে ডিক্রিপ্রাপ্ত হন। তাদের কাছ থেকে মারমেইড কর্তৃপক্ষ রেজিষ্ট্রি বায়না করে কাজ করছে।
তবে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (তহশিলদার) মো. সেলিম জানান, এ জমি সম্পূর্ণ খাস খতিয়ানভূক্ত। এক নম্বর খাস খতিয়ানের ৫০০ দাগের সরকারি এ জমিতে তারা অবৈধভাবে জবরদখল ও স্থাপনা নির্মাণ করছে। এমনকি স্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটার কথা শুনে সরেজমিন পরিদর্শন করে এ সবের সত্যতা পেয়েছেন। তাদের কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন।
কক্সবাজার ধরি্ত্রী রক্ষায় আমরা’র (ধরা) আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, দিন দুপুরে যেভাবে প্যারাবন, খাল ও সাগরপাড় দখল, হাজার হাজার গাছ নিধন করে ধংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে সেটি উদ্বেগজনক। পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় এসব জীববৈচিত্র্য বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চালানো হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্রশাসনের নিরবতাকে পূঁজি করে বিনা বাঁধায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে যাচ্ছে তারা।
এসব পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান পরিবেশবাদী এ নেতা।
কক্সবাজার পরিবেশ আন্দোলন বাপার সভাপতি এইচ এম এরশাদ বলেন, মারমেইড রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ যা করছে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তাও আবার কক্সবাজারের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিমছড়ি-প্যাঁচার দ্বীপ সংলগ্ন এলাকার সাগরতীরের গাছগাছালি উজাড় করা মানেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনার মতো ঘটনা।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম সোহেল বলেন, যেখানে দখল ও স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে ছোটকাল থেকে দেখে আসছি জোয়ার-ভাটা খাল, প্যারাবন, বিশাল চর ও ঝাউবন। সরকারি খাস খতিয়ান বলে জানা রয়েছে। বছরের পর বছর নানা কৌশলে দখল করা হচ্ছে। বিশাল কাঠের সাঁকো তৈরী করা হয়েছে। সেখানে এখন অনেক স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থানীয় তহসিলদার ও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা এসে বারংবার বারণ করা হলেও স্থাপনা নির্মাণ ও জবরদখল বন্ধ হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে মারমেইডের মালিক সোহাগ ও তার ভাই শাহিনের সাথে যোগাযোগ করা চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। জমি দেখাশুনার দ্বায়িত্বরত সৈয়দ আলম সুলতান জানান, তারা দেশের বাইরে রয়েছেন।
প্যারাবন কেটে স্থাপনা নিমার্ণের সত্যতা স্বীকার করেছেন রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিরূপম মজুমদার।
তিনি জানান, বিষয়টি জানার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন করে কাজ না করার জন্য বলা হয়েছে। নতুন করে কাজ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিএনএনিউজ/ বিএম