আজিজুল হাকিম : ঈদুল ফিতরকে ঘিরে রাজধানীতে ছিনতাই, অজ্ঞান ও মলম পাটির সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। প্রতিদিন হাসপাতালে এসে ভূক্তভোগিরা চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন কি মারাও যাচ্ছেন। গত বুধবার ভোরে রিকশায় শান্তিনগর যাচ্ছিলেন পরিচ্ছন্নকর্মী সুনিতা রানী দাস (৫০)। শান্তিনগরে একটি দোকানে তাকে কাজে দেবেন বলে তার খালা আগে থেকে কথা বলে রেখেছেন। ভোর ৬টার দিকে তাদের আরোহী রিকশাটি কমলাপুর বাস ডিপোর সামনে পৌঁছালে সাদা রংয়ের একটি প্রাইভেটকারে থাকা দুই ছিনতাইকারী তার খালার কাঁধে ঝুলানো ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়।
তখন রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন সুনিতা রানী। ছিনতাইকারীরা ব্যাগ নিয়ে প্রাইভেটকারে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত সুনিতা রানীকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে গেলে বেলা সোয়া ১১টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত বুধবার ভোর সাড়ে ৫টায় পলাশীর থেকে রিকশাযোগে কারওয়ানবাজার লেবু আনতে যাচ্ছিলেন সাগর (২৫) ও ইমরান (২১) নামের দুই যুবক। এসময় ৩/৪ জন যুবক তাদের রিকশার গতিরোধ করে তাদের ছুরিকাঘাত করে ৪ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এসময় তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ দিকে গত সোমবার দিবাগত রাত ১২টায় রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের উপর ছিতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে মামুন অর রশিদ (৪৫) নামের এক কাপড় ব্যবসায়ী আহত হন। তার কাছ থেকে ১৯ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায় ছিনতাকারীরা। আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেন। শুধু পশালী কিংবা মুগদাই নয়। গাবতলী, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আসাদ গেট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ফার্মগেট পুলিশ বক্স, আনন্দ সিনেমা হল, কারওয়ান বাজার, গাবতলী, বাংলামোটর, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, নিউমার্কেট, পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, বিমানবন্দর রেল স্টেশন, মতিঝিল, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, টিকাটুলী, সায়েদাবাদ, জুরাইন, পোস্তাগোলা, লালবাগ, সদরঘাট, কাকরাইল রাজমনি সিনেমা হল, ফকিরাপুল, কমলাপুর, মালিবাগ, শান্তি নগর, মৌচাক, মগবাজার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন মোড়, সাতরাস্তা মোড়, মহাখালী, চেয়ারম্যান বাড়ি, বিজয় সরণি, গুলশান মোড়, উত্তার বাড্ডা, বনশ্রীতে অজ্ঞান ও মলম পার্টির বেশি সক্রিয় ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর শতাধিক পয়েন্টে সক্রিয় অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা। মলম পার্টির সদস্যরা সাধারণ মানুষকে খপ্পরে ফেলতে কখনো ফল বিক্রেতা, শরবত বিক্রেতা, কখনও সিএনজি চালক, কখনও ফেরিওয়ালা সাজছে। কৌশলে নেশা জাতীয় উপাদান মিশ্রিত হালুয়া এবং ট্যাবলেট খাইয়ে অচেতন করে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আতরের সঙ্গে চেতনানাশক মেডিসিন মিশিয়ে বিক্রির নামে মাঠে কাজ করছে তারা।
জানা যায়, চলতি বছরে রাজধানীতে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অজ্ঞান ও মলম পার্টি সদস্যদের বিরুদ্ধে ৩৮৬টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্য ৩৬৮ জনকে ৬ মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সাজা দেওয়া হয়েছে। মোট ২৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গত কয়েকদিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান ও মলম পার্টির ১৫ সদস্যকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
একই সঙ্গে তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে বেশ কিছু চেতনানাশক ওষুধ। গত ৭ মার্চ যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে মলম পার্টি, অজ্ঞানপার্টি ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গত ৫ মাসে এই চক্রিয় শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কৌশলী অজ্ঞান পার্টি: কোমল পানীয় কিংবা বোতলজাত খাবার পানির সঙ্গে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইনসুলিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় অজ্ঞান করার রেসিপি। আবার গণপরিবহনে সিটের কাছে ক্লোরোফর্ম জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ লাগিয়েও অজ্ঞান করার কাজটি করা হয়। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এলাকা ভাগ করে ‘অপারেশন’ পরিচালনা করছে। আবার টার্গেট ভিত্তিক এলাকার বাইরে চলে গেলে তাদেরকে নিজেদের আয়ত্তে রাখতেও দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় রিলে দৌড়ের মতো। পার্টির কেউ সাজছে ডাব বিক্রেতা, কেউ পানির ফেরিওয়ালা, কেউ হচ্ছে সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী, আবার অজ্ঞান করা কিংবা চোখে মলম লাগানোর ক্ষেত্রে স্বল্প পাল্লার মাইক্রোবাসকে ব্যবহার করছে তারা।
শাহজাহানপুর রেললাইন বস্তির যুবক নুরু-আলম (ছদ্মনাম) যিনি অজ্ঞান পার্টির সদস্য। তিনি বলেন, আমার ওস্তাত শামিম সরদার। ওস্তাদের কাছ থেকে এ কাজ শিখেছি। এছাড়া অভাবের সংসার, টাকার লোভে পড়ে এ পথ বেছে নিয়েছি। একাজ করতে গিয়ে গত মাসে পুলিশের হাতে ধরা পড়ি, এর ২০ দিন পরে জামিনে বের হয়ে একই কাজ করছি।
তিনি আরও বলেন, কারওয়ানবাজার রেললাইন বস্তি, রেলস্টেশন বস্তি ও নাখালপাড়া বস্তির উঠতি অনেক যুবক এফডিসি গেট, সার্ক ফোয়ারা, বাংলামোটর ও ফার্মগেট পার্ক বস্তির এলাকায় এ কাজের সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে টগর, মাসুদ, রিফাত অন্যতম। এরকম প্রতিটি পয়েন্টে একেকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির দায়িত্বে রয়েছে শামিম হাওলাদার বলে জানা গেছে।
ভুক্তভোগি জিহাদ তালুকদার বলেন, গত সোমবার রাতে খিলগাও এলাকায় অফিসের কাজ শেষে রিকশাযোগে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা আমার দিকে স্প্রে করলে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে দেখি আমার পকেটে থাকা নগদ ১২’শ টাকা ও মোবাইল সেট নাই। এর পর স্থানীরা আমাকে বাসায় পোঁছে দেন।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মিডিয়া সোহেল রানা বলেন, ঈদুল ফিতরকে ঘিরে অজ্ঞান ও মলম পার্টি কিছুটা বেড়েছে। তবে তাদেরকে গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যহত রয়েছে। এই চক্র কৌশলী হয়ে কাজ করছেন। তারা রাস্তায় খাবারের পসরা বসিয়ে আখের রস, ডাব ও হালুয়া খায়িয়ে সব কিছু লুট করে নিচ্ছে। মলম পার্টির সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে অজ্ঞান পার্টির বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে সব সময় সাদা পোশাকে ও মোবাইল টিম কাজ করছে।
বিএনএনিউজ/আজিজুল,জেবি