বিএনএ,ঢাকা: জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের পচন শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সাল থেকে। ওই সময়ে ক্ষমতায় ছিলেন আওয়ামী লীগ। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসীম উদ্দিন মানিক সেই সময় ধর্ষণে শতক উযাপন করেছিলেন। তার এহেন কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছিল অনেকটা নমনীয় ও মানবিক! যদিও পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বহিস্কার করে দায়িত্ব শেষ করে। তারই ধারাবাহিকতায় একের পর এক চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নারী নিপীড়ন ও মারধরসহ নানা অপরাধে আলোচনায় এসেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।
তবে ২৬ বছর পর আবারও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। যদিও গণ ‘ধর্ষণকাণ্ডে’ জড়িত থাকার অভিযোগে ছাত্রলীগের চার নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
ইতিপূর্বে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘মানবিকতা’ দেখায়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে মীমাংসা করার চেষ্টা চালায়। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধ বাড়ছে। গণরুম-গেস্টরুম কালচার বন্ধ না করা এবং বিভিন্ন সময়ে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না করাই ‘ধর্ষক’ মানিক ও মোস্তাফিজের জন্ম দিয়েছে।
২০২৩ সালের পহেলা মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী পানধোয়া এলাকার ডিশ ব্যবসায়ী মমিনউল্লাহ মমিনের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক শান্ত মাহবুব এবং উপদপ্তর সম্পাদক হাছিবুর রহমান। টাকা না পেয়ে লাইনম্যান খায়রুলকে ক্যাম্পাসে এনে মারধর করেন তারা। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। এরপর ৫ মে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাব্বির হোসেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদি হাসানের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী ইসলামনগর বাজারে এক জুতার দোকানদার ও তার কর্মচারীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষার্থীকেও মারধর করেন তারা।
একই বছরের ২৫ জুলাই সাভার থেকে আশুলিয়া রুটে চলাচলকারী লেগুনা থেকে দৈনিক ২৫ টাকা হারে চাঁদা দাবি করে ২৪টি লেগুনা ক্যাম্পাসে আটকে রাখার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল ফারুক ইমরান, শাহ পরাণ ও হাসান মাহমুদ ফরিদ, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, লেলিন মাহবুব ও উপছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আল-রাজি সরকারের বিরুদ্ধে। সে সময় লেগুনা মালিকদের থেকে ছাত্রলীগের চাঁদা আদায়ের ভিডিও ভাইরাল হয়।
এছাড়া গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক অসিত পালের বিরুদ্ধে নেশাদ্রব্য খাইয়ে বাসে উঠিয়ে ঢাকার খিলগাঁও থেকে এক বহিরাগতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সালাম-বরকত হলে এনে বেধড়ক মারধরের পাশাপাশি ৪৫ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ ওঠে। পরে অসিত পালকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এদিকে গত বছরের ১৬ মে সায়েম হাসান নামের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী কানে অস্ত্রোপচার করায় ছাত্রলীগের গেস্টরুমে যাননি। এ কারণে শহিদ সালাম-বরকত হলের পলিটিক্যাল ব্লকে ডেকে নিয়ে তাকে হল ছাত্রলীগের নেতারা মারধর করেন।
এছাড়া গত বছরের জুলাইয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে নিজের গাড়িতে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগে কিছু শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী দিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক। পরে নিরাপত্তা শাখার কাছে হস্তান্তর করে এবং ৭৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে তিন দিন পর অ্যাম্বুলেন্সটি ছেড়ে দেন। এছাড়া ঐ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ছয় নেতার বিরুদ্ধে এক বহিরাগতকে তুলে নিয়ে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ ওঠে। এদিকে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে শাখা ছাত্রলীগের কয়েক জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ দেন ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মামুনুর রশিদ। তবে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগীকে না ডেকেই অভিযোগ গায়েব করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, ২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখের দিন আদিবাসী এক ছাত্রীকে যৌন হেনস্তা, ছিনতাই ও মারধরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে স্থায়ী বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। যারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। এরপর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত এক নারীকে ইভটিজিংয়ে বাধা দেওয়ায় এক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তিন ছাত্রলীগ কর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়া ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত ও এক সংবাদকর্মীকে মারধরের অভিযোগে ছাত্রলীগের পাঁচ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। একই বছরের নভেম্বরে এক শিক্ষার্থী ও তার বান্ধবীর কাছে চাঁদা দাবি করে না পাওয়ায় মারধর ও ধর্ষণের হুমকি দিয়ে কানের দুল ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ছাত্রলীগের তিন জনকে আজীবন এবং দুজনকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
এ দিকে ২০২৩ সালের আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরতে এসে ছিনতাইয়ের শিকার হন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই নেতাকর্মী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
এর আগে, ২০২২ সালের জুন মাসে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে মারধর ও আরেক নারী শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে হেনস্তার অভিযোগ ওঠে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ বছর আগে ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের ছোট ভাই আরমান খান যুব। বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে থাকেন তিনি। কক্ষটিকে তিনি ‘টর্চার সেল’ বানিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে প্রায়ই বাহির থেকে লোক ধরে এনে মারধর করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এছাড়া ছাত্রলীগের অনেক নেতা সেখান থেকে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, ‘বৃহৎ ছাত্র সংগঠন হওয়ায় প্রতিটি সদস্যের বিষয়ে সার্বক্ষণিক তদারকি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এরই সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু লোক বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। যার কারণে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। ভবিষ্যতে বেশি বেশি কাউন্সেলিং ও কর্মিসভার মাধ্যমে শাখা ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
বিএনএ/ শামীমা আকতার শাম্মী, ওজি/এইচমুন্নী