।। আব্দুল্লাহ আল মাহবুব শাফি ।।
বিএনএ, নোবিপ্রবি: সীতাকুণ্ড। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য স্বর্গরাজ্য। চট্টগ্রামের এই সীতাকুণ্ডতেই রয়েছে অত্যন্ত রোমাঞ্চের ও সুন্দর একটি ট্রেইল। ‘ঝরঝরি’। ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এটি অনেক জনপ্রিয় স্থান। ঝরঝরি ঝর্ণার মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখলে যেকেউই বিস্মিত হতে বাধ্য।
নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমরা নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) শিক্ষা বিভাগের ৩টি ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থীরা ট্যুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের ভ্রমণস্থান ঠিক হয় রোমাঞ্চকর ঝরঝরি ট্রেইল। শিক্ষা বিভাগের ১৫তম ব্যাচ থেকে আমি, মোস্তাফিজ, ইরিন, আমিনুল, মাসুদ; ১৬ তম ব্যাচ থেকে হিমেল, লামিয়া, তৌহিদ, হ্যাপি, মিতু, ইসরাত, রাফা; ১৭ তম ব্যাচ থেকে রাশিক, নন্দিতা, মৃত্তিকা, পৃথা, মেহরাব, মীম, অন্তিক, অর্পিতাদের নিয়ে যাত্রার তারিখ নির্ধারিত হয় ১ অক্টোবর। আমাদের পরিকল্পনা ছিল নিখুঁত। সকাল সকাল বের হয়ে দ্রুত ট্রেইলে পৌঁছে ঝর্নার পথ ধরা। আমাদের লক্ষ্য ছিল সোনাপুর থেকে সকাল সাড়ে ৬ টার দ্রুতযান ধরে ফেনীতে পৌঁছা।
পুরো যাত্রাপথের পরিকল্পনাটি সবার সাথে শেয়ার করে আগের রাতে ঘুমাতে গেলাম। তারপর দিনের ভোররাতে নোয়াখালীতে শুরু হয় প্রচন্ড বজ্র ঝড়। ভোর ৫টা বাজে তৌহিদের ফোন। ভাই, ট্যুর কি হবে? বললাম পরিস্থিতি যেভাবেই থাকুক, ট্যুর হবেই।
কিন্তু বিধিবাম। ক্যাম্পাস এরিয়ার সবাই নির্ধারিত সময়ে সোনাপুর বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছালেও একজন আসতে লেট করে ফেলেন। সে হলো মিতু। ঘুমন্ত মিতু। অজস্র ফোনকল, মেসেজের পর অবশেষে সে ওঠে। অবশেষে ১ ঘন্টা বিলম্বে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। ফেনী পৌঁছাই সকাল ৯ টায়। ৩০ মিনিটের যাত্রা বিরতিতে আমরা নাস্তা পর্ব সেরে নিই সবাই। ৯ টা ৪৫ এর দিকে আমরা ফেনীর মহিপাল থেকে সীতাকুণ্ডের পন্থিছিলা বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পথিমধ্যে বাসে ছোটভাই হিমেল গানের আসর বসায়। পুরো রাস্তা মাতিয়ে রাখে সে। আমরা সবাই বিভিন্ন গানে গলা মিলাই। বেলা এগারোটার দিকে আমরা নামি সীতাকুণ্ডের পন্থিছিলা বাজারে। নেমে ট্র্যাকিংয়ের জন্য এংলেট, পথে খাওয়ার জন্য শুকনো খাবার আর পানি কিনি। আর আমাদের ট্যুরের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব ছিল মোস্তাফিজের কাছে। পন্থিছিলা বাজার থেকে ১০ মিনিট হেঁটে পৌঁছাই রেলবিট। রেললাইন ধরে বা দিকে ৫ মিনিট হাঁটার পরই আমাদের মূল ট্র্যাকিং শুরু হয় ঝরঝরি ঝর্নার উদ্দেশ্যে। এই ট্রেইলে রয়েছে অনেক ক্যাসকেড আর ঝর্না। সেখানকার সবচেয়ে সুন্দর ক্যাসকেড হলো প্রাকৃতিক সিঁড়ি। যা স্বর্গের সিঁড়ি নামেও পরিচিত। প্রাকৃতিকভাবেই সিঁড়ির মতো খাঁজকাটা। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড রেইঞ্জের সবচাইতে বুনো ট্রেইল বলা হয় এই ঝরঝরি ট্রেইলকে। এই ট্রেইলে দেখা যায় জোঁক, বানর, সাপসহ নানা প্রাণী। এছাড়া ফলের মৌসুমে এই ট্রেইলে পাওয়া যায় আম, কাঁঠাল, জামসহ আরও নানাকিছু। এই ঝর্ণাটায় বলা যায় প্রায় সারা বছরই কমবেশি পানি থাকে।
ট্রেইলের শুরুতে আমরা আমাদের ব্যাগপত্র পথিমধ্যের একটি টংয়ে রাখি। কিছুদূর যাওয়ার পর ঝিরিপথ শুরু হয়। পানির মধ্যে হেঁটে যাওয়ার রোমাঞ্চ বলে বোঝানোর মত না। ঘন্টাখানেক ঝিরিপথ দিয়ে হাটার পর খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার পালা। পিচ্ছিল কর্দমাক্ত খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠা ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। প্রথম পাহাড়টিতে ওঠার পর আমরা প্রকৃতির যে ভিউ দেখেছিলাম তা অনন্য, অসাধারন। মেঘেদের মেলা বসেছিল পাহাড়ে- পাহাড়ে। এই ভিউ পয়েন্টে আমরা সবাই মিলে কিছু ছবি ভিডিও তুলি। তারপর আবার আমাদের ট্র্যাকিং শুরু হয়। পরের পাহাড়ে চড়ার সময় আমরা মেঘেদের আলিঙ্গন করে যাই। আমাদের ট্রেইলের রাস্তা ধরে পাতলা মেঘের ভেলা ভেসে যাচ্ছে। দুপাসে পাহাড় মাঝখানে আমরা মেঘেদের সাথে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। সে এক অনন্য অনুভূতি। ট্র্যাকিংয়ে আমাদের সবাইকেই জোঁকের কামড় খেতে হয়েছে। কারো পিঠে, কারো পায়ে, কারো হাতে জোঁকে কামড়িয়েছে। ঝিরিপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কানে ভেসে আসে পাখির কিচির মিচির, রং বাহারি প্রজাপতির আনাগোনা। দুই পাশে সুউচ্চ পাহাড়। শোঁ শোঁ শব্দে পাহাড় থেকে অবিরাম শীতল পানি গড়িয়ে যাচ্ছে ছড়া দিয়ে। মেঘের মতো উড়ে আসা শুভ্র এ পানি আলতো করে ছুঁয়ে দেখলেই যেন শীতল পরশ মুহূর্তে ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়, ঝরনায় যাওয়ার পথে পথে দেখা মিলে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও রং বেরংয়ের কীটপতঙ্গ। শোনা যাবে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুঞ্জন, অচেনা পাখিদের ডাক। সবকিছু মিলে এ এক অন্যরকম অনুভূতি। সবাই পথে যে যার মত ছবি তুলে যায়। ফটোগ্রাফার বন্ধু আমিনুল এই প্রকৃতি দেখে যেন ঈদের চাঁদ হাতে পায়। মোবাইল দিয়ে তুলতে থাকে প্রকৃতির অসম্ভব সুন্দর সব ছবি। ধারণ করতে থাকে বিভিন্ন ভিডিও।
এভাবে পাহাড়, ঝিড়িতে দীর্ঘ আড়াই থেকে তিনঘন্টা ট্র্যাকিং করে আমরা ঝরঝরি ঝর্নায় পৌঁছাই। পাহাড়ের গাঁ বেয়ে জলের ধারা মনমুগ্ধকর সৌন্দর্য তৈরি করে নেমে আসছে নিচুতে। কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি ঝিরিপথ পাড়ি দেওয়ার পর সেই ঠাণ্ডা জল জুড়িয়ে দেয় আমাদের প্রাণ।
সুনসান নীরব চারদিকে শুধু ঝর্নার হুংকার আর নিচে আছড়ে পড়ার গর্জন। অপূর্ব, অসাধারণ, অদ্ভুত সুন্দর, অসহ্য সুন্দর। এখানে যেন সময়ের কাটা এগিয়ে চলে কিন্তু সৌন্দর্য পিপাসার তৃষ্ণা মেটে না। ঝর্নায় পৌঁছে সবাই যখন উৎফুল্ল তখন প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের পশরা আরেকটু মেলে ধরে বৃষ্টি ঝরানো শুরু করে। ঝর্নায় বৃষ্টি বিলাস। সবার আনন্দ হয়ে যায় দ্বিগুন। ঝর্নার নিচে দাঁড়িয়ে সবার কি আনন্দ। কেউ ঝর্নার পাদদেশে সাঁতার কাটে, কেউবা ঝর্নার নিচে দাঁড়িয়ে সব দু:খ কষ্ট ভাসিয়ে দেয় পানিতে, আবার কেউ কেউ ঝর্নার পাশে চুপ করে বসে থেকে উপভোগ করতে থাকে স্রষ্টার সৃষ্টি।
আমরা কয়েকজন পাদদেশে কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে পাহাড় বেয়ে উঠে যাই ঝর্নার উপরে। বন্ধু, জুনিয়রদের সাথে এক এক অন্যরকম মুহূর্ত। ঝর্নায় সবাই যেন আনন্দের পসরা মেলে ধরেছে। ঘন্টাখানেক ঝর্নায় অবস্থান নিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরি। আবার একই ট্র্যাক ধরে আমরা ধীরে ধীরে লোকালয়ে নেমে আসি। তখন ঘড়িতে বাজে বিকেল ৪ টা বেজে ১০ মিনিট। সেখানে এসে আমরা সবাই আমাদের ব্যাগপত্রগুলো বুঝে নিয়ে জামা- কাপড় পরিবর্তন করে নিই। হালকা কিছু খাবার খেয়ে আমরা এই বিকেলবেলা দুপুরের খাবার খেতে রওনা হই সীতাকুণ্ডের বিখ্যাত ভাবীর হোটেলের উদ্দেশ্যে। আমাদের কিছু হিন্দু ছোট ভাই- বোনদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয় সীতাকুণ্ড বাজারের একটি রেস্টুরেন্টে। সবাই আমরা ভালো করে পেটপূজো করে নিই। সারাদিনের পরিশ্রমের পর এই খাবার যেন আমাদের কাছে মহামূল্যবান হয়ে ওঠে।
পেট ভরে খেয়ে আমরা সীতাকুণ্ডের বাস স্ট্যান্ডে আসি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। বাস কাউন্টার থেকে জানানো হয় বাস আসবে ত্রিশ মিনিট পর। সবাই মিলে কাউন্টারে বসে আমরা আড্ডা দিতে থাকি। সারাদিনের গল্পগুলি আমরা আবার বলতে থাকি একে অপরকে। এভাবে একসময় বাস চলে আসে। উঠে যাই আমরা সবাই। এবার ফেরার পালা। এই রোমাঞ্চকর ভ্রমণ যে শেষ হতে চলেছে, আবার কবে আসবো এই ট্রেইলে বা আদৌ আসা হবে কিনা এই ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সীতাকুণ্ডের প্রকৃতির মায়ায় যে একবার পড়ে সে এটির নেশায় পড়ে যায়। বারবার ফিরে আসতে চায় সবাই এই প্রকৃতি মাতার কোলে। আমাদের বাস এগিয়ে যেতে থাকলো, ধীরে ধীরে সীতাকুণ্ড আমাদের সীমানা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আমরা ফেলে আসলাম প্রকৃতির মাঝে জেগে থাকা এক অবারিত সৌন্দর্যের স্বপ্নভূমিকে। আর সাথে করে নিয়ে আসলাম এক আকাশ সমান অভিজ্ঞতা আর ঝরঝরি ট্রেইলের স্মৃতি হিসেবে ধারণ করা ছবি- ভিডিও। শেষ বয়সে মোবাইলে তুলে নিয়ে আসা ছবিগুলো দেখে হয়তো আমাদের চোখগুলো ভিজে যাবে নোনাজলে। অনুভূত হবে সেইসব রোমাঞ্চকর দিনগুলি।
বিএনএনিউজ/ বিএম