20 C
আবহাওয়া
৪:১৫ পূর্বাহ্ণ - নভেম্বর ২৪, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » ছাগলনাইয়ার যশপুরের ‘সুলতান ভিলা’ ও ‘কাব্য কথায় হেমন্ত’!

ছাগলনাইয়ার যশপুরের ‘সুলতান ভিলা’ ও ‘কাব্য কথায় হেমন্ত’!

সুলতান ভিলা

।।ইয়াসীন হীরা।। বুদ্ধদেব বসুর মতে, ‌‘আড্ডা’ শব্দটি উর্দু থেকে বাংলায় এসেছে। ‘আড্ডা’ কখন কীভাবে শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও ব্যাসদেবের মহাভারতে বর্ণিত আছে, নৈমিষারণ্যে ‘একদা মহর্ষিগণ দৈনন্দিন কর্ম্ম সমাধান করত, সকলে সমবেত হইয়া কথা-প্রসঙ্গে সুখে অধ্যাসীন হইয়া আছেন।’ অর্থাৎ আড্ডা দিচ্ছেন। এতে বুঝা যায়, মুনিঋষিরা তাদের জপ ও তপের মাঝে রীতিমতো আড্ডা মারতেন! শুধু প্রাচীন ভারত নয়, প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও আড্ডা দিতেন শিল্প সাহিত্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

আড্ডা দিতেন সক্রেটিস, প্লেটো অ্যালসিবায়ডিসের মতো ব্যক্তিরাও। সাহিত্যিক নাগিব মাহফুজ আড্ডা দিতেন মিশরের কায়রো শহরে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আমেরিকার নিউ জার্সি’র বেশ কয়েকটি শহরে আড্ডার কথা জানা যায়। আধুনিক যুগে শিল্পী পাবলো পিকাসো আড্ডা জমাতেন মাদ্রিদ ও প্যারিস শহরে। জাঁ পল সার্ত্রে ফ্রান্সের বিখ্যাত ‘ক্যাফে দ্যা ম্যাগো’ (Les deux magot) নামে এক কফি হাউসে আড্ডা দিতেন।

দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা
দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা

তাইতো প্রখ্যাত নোবেলজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস বলেছেন,‌‘ আড্ডা প্রতিভা বিকাশের সহায়ক’। শিল্প সাহিত্যে সংস্কৃতির এক বড় উদ্দীপনা শক্তি হল বাঙালির আড্ডা। বাঙালির আড্ডা স্বভাবে এবং ভাষার আঙ্গিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ শুধু ক্ষণিকের বিনোদন নয়, বাঙালি মনন, চিন্তন, শিল্পসাহিত্যের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িত।

দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা
দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা

আড্ডার প্রসঙ্গ আসলেই অনিবার্যভাবেই ঠাকুর পরিবারের কথা। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত আড্ডা হতো। তবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়েই বিভিন্ন বিষয়ে আড্ডা  বেশি জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে। অক্ষয় চৌধুরী, জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের  আড্ডায় বসতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একদিন আড্ডা মারতে না পেরে কবি বন্ধুকে উদ্দেশ করে কবিতা রচনা করবার কথাও জানা যায় তাঁর ‘শ্রাবণের পত্র’ কবিতায়। কবি গুরু লিখেন ‘আমলা শামলা আাঁটিয়া নিত্য/তুমি করো ডেপুটিত্ব/একা পড়ে মোর চিত্ত/ করে ছটফট।’

সত্তর দশকের শুরুর দিকে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কবি সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। হাজির থাকতেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, অমিতাভ গুপ্ত, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এমনকী পরবর্তীকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। এখান থেকেই সংঘটিত হয়েছিল কৃত্তিবাস আন্দোলন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কফি হাউস হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম যোগাযোগ তথ্য কেন্দ্র। এই কফি হাউসের আড্ডাতেই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় শঙ্খ ঘোষকে ‘গরিবের রবীন্দ্রনাথ’, কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে ‘বাংলা কবিতার পোপ’ নাম দেন।

দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা
দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা

বিখ্যাত কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজের আড্ডা নিয়ে  গৌরি প্রসন্ন মজুমদার তো রীতিমত কালজয়ী একটি গানই রচনা করে ফেলেছেন! তার আক্ষেপ ‌‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই’।

ওপার বাংলার গৌরি প্রসন্ন মজুমদারের কফি হাউজের সোনালী বিকালের আড্ডা না থাকলেও বাঙ্গালীর আড্ডা থেমে নেই। সেটা যদি হয় শিল্প সাহিত্যের। তাহলে তো কথাই নেই।

দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা
দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা

৪ নভেম্বর (শুক্রবার) এপার বাংলার ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার উত্তর যশপুর গ্রামের সুলতান ভিলা। সকাল থেকে ঢাকা চট্টগ্রাম থেকে দেশ বরেণ্য লেখক, কথা সাহিত্যিক ও কবিরা দলে দলে উপস্থিত হতে শুরু করেন। সুলতান ভিলার ভিতরে রয়েছে পুকুর, লেকের সমন্বয়ে বিশাল পার্ক। পাশেই কাঁচাপাকা ধানক্ষেত। দুপুর গড়িয়ে হেমন্তের সোনালী বিকাল। শীতের আবহ ও পাখির কলকাকলিতে চা, কফির সঙ্গে চলছে আড্ডা। সঙ্গে নানা ঢংয়ে ক্যামেরায় বন্দি হওয়া তো আছেই।

কবি-সাহিত্যিক না হয়েও এমন আড্ডার আয়োজক বিশিষ্ট ব্যবসায়ি, বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি-বিএনএ সম্পাদক মিজানুর রহমান মজুমদার।  গ্রামীণ আবহে দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের  আড্ডার সমন্বয়ক ছিলেন ফেনী জেলার এডিসি ও বিশিষ্ট কবি ড. মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলাম (মানজুর মুহাম্মদ)।

দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা
দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা

জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘সমস্ত পৃথিবী ভরে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস’ শিরোনামে ‘কাব্য কথায় হেমন্ত’ কথা কবিতা-গান আড্ডা-অনুষ্ঠানটি হয়ে ওঠে দারুণ প্রাণবন্ত। উপস্থিত কবি সাহিত্যিকগণ যেন ক্ষণিকের জন্য ফিরে গিয়েছিলেন বাঙালি আড্ডাবাজ কবি বুদ্ধদেব বসুর কলকাতার ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর ‘কবিতা ভবন’এ!

দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা
দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা

তাঁর ভাষায়, ‘অন্য কোন দেশে বাঙালির আড্ডার মেজাজ নেই। আমাদের ঋতুগুলো যেমন কবিতা জোগায় তেমনি আড্ডাও জমায়। চৈত্র, বৈশাখ, শরৎ, হেমন্ত, শীত বা বসন্ত, সব ঋতুই যেন আড্ডার ঘন্টা বাজায়। তার প্রতিধ্বনি শোনা গেল বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা লেখক সেলিনা হোসেনের কণ্ঠে। অনুভূতি ব্যক্ত করলেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদক প্রাপ্ত  বিশিষ্ট কবি ও সাবেক  সচিব আসাদ মান্নান, সাবেক সচিব ও কবি ফারুক হোসেন, দৈনিক আজাদীর সহযোগী সম্পাদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি রাশেদ রউফ, বিশিষ্ট লেখক ও অভিনেতা আসলাম সানি, কথা সাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কবি জিন্নাহ চৌধুরী, কথা সাহিত্যিক ওমর কায়সার, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক রহিম শাহ, বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া, বিশিষ্ট কবি ও কথা সাহিত্যক মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, বিশিষ্ট লেখক ও চ্যানেল আইয়ের জেনারেল ম্যানেজার আমিরুল ইসলাম, বিশিষ্ট লেখক কামরুল হাসান বাদল, কবি ইকবাল চৌধুরী, কবি ইকবাল আলম, পাখি বিশেষজ্ঞ শরীফ খান, রাইর্টাস ক্লাবের সেক্রেটারি কবি সানাউল হক।

দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা
দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা

বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলা আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন, এজাজ ইউসূফী, ইউসুফ মুহাম্মদ, জিললুর রহমান, খালেদ হামিদী, সেলিনা শেলী, হাফিজ রশীদ খান, মোহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী, ইকবাল আলম, শাবিহ মাহমুদ, বকুল আকতার বড়ুয়া, সবুজ তাপস, সোহেল মোস্তাক, আরিফ রিজভী, ফারুক হোসেন, মনি হায়দার, হাসান রাউফুন, মঈন মুরসালিন, ফারুক আহেমদ, ইমরান পরশ, মঈনুল হাসান, অদ্বৈত মারুত, এবিএম আহসানুল কবির, মামুন সরওয়ার, মোজাম্মেল মাহমুদ, আশিক মুস্তাফা, নাফে নজরুল, রিজোয়ান মাহমুদ, মনিরুল মনির, এমরান চৌধুরী, মিজানুর রহমান শামীম, কামরুল হাসান বাদল, সেলিম আকতার পিয়াল, ওবায়েদ মজুমদার, মনজুর তাজিম, জিয়া উদ্দিন বুলবুলসহ অসংখ্য লেখক, কবি ও সাহিত্যিকগণ।

ড. মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলামের সঞ্চালনায় লেখক, কবি ও সাহিত্যকদের এ আড্ডায় সন্ধ্যায় শরিক হন ফেনীর জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান। কবিদের সম্মাননা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, লেখক, কবি ও সাহিত্যিকরা দেশ ও জাতির সম্পদ। তাঁরা মেধা, মনন দিয়ে জাতিকে পথ দেখান। আলোর দিশারী দেশের এই সূর্য সন্তানরা লেখনির মাধ্যমে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা
দেশ বরেণ্য লেখক, সাহিত্যিক ও কবিদের আড্ডা

উল্লেখ, যে বাড়িতে জমকালো ও স্মরণীয় আড্ডা বসেছিলো সেই বাড়ির মালিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম সুলতান আহমেদ। তিনি বিশিষ্ট সমাজ সেবক মিজানুর রহমান মজুমদারের শ্রদ্ধেয় পিতা। ১৯৭১ সালে এ বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। এখানে ২৯টি পরিখা খনন করে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন। সুলতান আহমেদ শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি  ছিলেন তৎকালীন ছাগলনাইয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। অনুষ্ঠানে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে দুই মিনিটের একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপন করা হয়।

পরিশেষে সুকুমার রায়ের কথার প্রতিধ্বনি করে বলতে হয়, ‘জুতোসেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সব বিষয়ে আলোচনা হয় মিজানুর রহমান মজুমদার আয়োজিত ছাগলনাইয়ার যশপুরে ‌’কাব্য কথায় হেমন্ত’ শীর্ষক লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের এ আড্ডায়।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি-বিএনএ।

Loading


শিরোনাম বিএনএ