বিএনএ, ঢাকা: ২০ বছর অবৈধভাবে চেয়ারম্যান পদ আঁকড়ে ধরে ছিলেন সাউথ ইস্ট ব্যাংকের আলমগীর কবির। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি ঋণ জালিয়াতি, পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারি, অর্থপাচার ছাড়াও শাখা সম্প্রসারণ, শাখা ইন্টেরিয়র, ব্যাংকের বুথ বসানো এবং সফটওয়্যার সরবরাহের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব অর্থ কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে পাচার করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা দেয়া, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক অভিযোগপত্রে এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
জানা যায়, ২০০৪ সালে আলমগীর কবির সাউথ ইস্ট ব্যাংকের চেয়াম্যানের দায়িত্বে আসেন। টানা ২০ বছর দায়িত্ব পালনকালে অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছেন। পাশাপাশি অন্য পরিচালক ও ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নিজ লোকদের ঋণ দেওয়া এবং চলতি ঋণের সুদমওকুফ করে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটান। তার এইসব অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত না হতে অন্য পরিচালকরা বোর্ড সভায় উপস্থিত হওয়া বন্ধ করে দেন। এ সুযোগে আলমগীর কবিরের অনিয়মের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কানাডার বেগমপাড়া, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার আমপাং এলাকায় তার বাড়ি রয়েছে। দুবাইয়ে বিলাসবহুল হোটেল ও বার রয়েছে। তাছাড়া ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। গাজীপুরে রয়েছে বাড়ি। শ্রীপুর, ভাওয়াল ও কাঁচপুরে তার অন্তত ১৫০ বিঘা জমি রয়েছে বলে অভিযোগে তুলে ধরা হয়।
আলমগীর কবির সাউথ ইষ্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে থাকা অবস্থায় ব্যাংকের টাকায় ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স, বেলিজিং ও এশিয়া ইনস্যুরেন্সের বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন। পরবর্তীতে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা উপদেষ্টার পদ দখল করেন আলমগীর কবীর। তৈরি করেন নিজস্ব লোকজন নিয়ে একটি সিন্ডিকেট। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনের কারণে তিনি লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংকটি। দুটিপ্রতিষ্ঠানের নামে অনৈতিকভাবে মোটা অঙ্কের ঋণও দিয়েছেন।
আলমগীর কবির তার নিকটাত্মীয়ের মালিকানাধীন লুব-রেফ বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে প্রায় ৫৪ কোটি টাকার বেশি সুদ মওকুফ করে দিয়েছেন। এইসুদ মওকুফের কৌশল হিসেবে প্রথমে লুব রেফের ঋণ, সাউথ ইস্ট ব্যাংক কিনে নেয়। ব্যাংক সেই টাকা একেবারে পরিশোধ করলেও, লুব রেফের অ্যাকাউন্ট সন্দেহ এড়াতে ছোট ছোট পরিমাণে এফডিআর হিসাবে জমা দেয়া হয়। ঋণের পুরো সুদ একবারে মওকুফ না করে তা অল্প করে মওকুফ করা হয়, যাতে ব্যাংকের বোর্ডে সন্দেহ না হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি সুদ মওকুফের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিপোর্ট করতে হয়। আলমগীর কবির ইন্টারেস্ট রেপিড নামে এক পদ্ধতি করে, লেমেরিডিয়েনের ঋণের সুদ মওকুফের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকে জানাননি। অনিয়মের মাধ্যমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেন। এসব ঋণের বিপরীতে গ্রাহকদের কাছ থেকে পাঁচ বছরে কোনো সুদ দিতে হবেনা বলে সুবিধা দিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে আলমগীর কবির কেয়া গ্রুপের ৯০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেন। এজন্য কেয়া গ্রুপ সাউথইস্ট ব্যাংকের সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট অতিক্রম করে। তা সত্বেও তিনি ঋণ দেন মূলত শতকোটি টাকার কমিশনের বিনিময়ে। এছাড়া ফাহমীনিট ৩০০ কোটি টাকা ও মাহাবুব স্পিনিংয়ে ১৫০ কোটি টাকার ঋণ বেআইনিভাবে বিতরণ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দেয়া টিআইবি’র অভিযোগ পত্রে দেখা যায়, প্রকৃতমূল্যের অতিরিক্ত দামে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার জন্য খুবই নিম্মমানের প্রায় ৫০০টি ক্যাশরি সাইক্লিং মেশিন ক্রয় করে। এক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্যের অতিরিক্ত অর্থ ওভার ইন ভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ওভার ইন ভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা তিন কোম্পানিতে পাঠানো হয়েছে। এগুলো হলো ‘আরঅ্যান্ডএন ট্রেড হোল্ডিংস প্রাইভেট লিমিটেড, ই-এক্সচেঞ্জ সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড ও আরঅ্যান্ডএন মেরিন অ্যান্ড শিপ ট্রেড প্রাইভেট লিমিটেড। এতে প্রায় ২০ কোটি টাকার অধিক অর্থ শেয়ার মানি হিসেবে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এছাড়া আলমগীর কবির সাউথ ইস্ট ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত দুটি সিডিএম এটিএম মেশিন বসান। প্রতিটি সিডিএম, এটিএম মেশিন কেনা হয় ‘জারাজামান টেকনোলজি’ নামের প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রত্যেকটি এটিএমের জন্য ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে ২৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিল করা হয়েছে, যা স্বাভাবিক বাজারদরের তুলনায় দু-তিনগুণ বেশি।
প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘ ২০ বছর পরে নতুন চেয়ারম্যান পেয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক, এ পদে ফিরেছেন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তা পরিচালক এম এ কাশেম।
রোজ কর্নার প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম এ কাশেম একসময় বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি ছিলেন। নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টের এই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চারবার ওই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিএনএনিউজ/ সৈয়দ সাকিব/ বিএম