১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দি ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক অসংখ্যবার কারাগারে বন্দি রেখে বাঙ্গালী জাতিকে দাবিয়ে রাখার অপচেষ্টা করেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর শুধু প্রথম তিন মাসে বঙ্গবন্ধুকে মোট আটবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো।কারাগারে নিজের, কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও অন্য বন্দিদের সুখ, দুঃখ, কারাগারে বিভিন্নভাবে নির্যাতন বিভিন্ন সময়ে খাতায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এর নাম দিয়েছিলেন ‘থালাবাটি কম্বল / জেলখানার সম্বল’।
‘কারাগারের রোজনামচা’
বঙ্গবন্ধুর কারাগারে লেখা খাতাগুলো খুঁজে পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা পরে ২০১৭ সালের ১৭ই মার্চ বই আকারে প্রকাশ করা হয় ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামে । বইটির ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা এবং নামকরণ করেছেন তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা।
এই বইয়ে শুধু কারাগারের চিত্রই নয়, ফুটে উঠেছে সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পাকিস্তান সরকারের এক নায়কোচিত মনোভাব ও অত্যাচার-নির্যাতনের নানান চিত্র। ফুটে উঠেছে, দেশ ও মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাবনা, রাজনৈতিক দর্শন,ত্যাগ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের অজানা কাহিনী বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) ধারাবাহিকভাবে ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশ করছে।
আজ প্রকাশিত হলো- পর্ব-১৯
আবার এমন ডাক্তার দেখেছি যারা জেলখানায় পানিও মুখে দেয় না, ঘুষ তো দূরের কথা। রোগীদের ভালভাবে চিকিৎসা করে, রাতদিন পরিশ্রম করে। আবার এমন ডাক্তার জেলে দেখেছি, সুন্দর চেহারা, মুখে দাড়ি, নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়ে গেছে দেখলে মনে হয় একজন ফেরেস্তা ।
হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে কয়েদিরোগীদের ডাইট থেকে ডিম, গোস্ত,
রুটি খুব পেট ভরে খান, আর ঔষধও মাঝে মাঝে বাইরে নিয়ে বিক্রি করেন।
হাসপাতালে রোগীদের জন্য আলাদা পাক হয়। এখানটায় হলো খাওয়ার আড্ডা। কয়েদিরা কথা বলতে সাহস পায় না, তাই তাদের মুখের গ্রাস অনেকেই খেয়ে থাকেন। একজন ডাক্তারকে আমি জানতাম, মুখে খুব ভদ্রলোক। আসতে সালাম, যাইতে সালাম, খবর নিয়ে জানলাম তিনি এক প্যাকেট সিগারেটও ঘুষ খান।
জেলে কোনো ঘটনা চাপা থাকে না। যে কোনো ঘটনা জেলখানায় আধা ঘণ্টার ভিতর আড়াইহাজার কয়েদির কানে চলে যাবে।
আমাকে ও মওলানা সাহেবকে মেডিকেল ‘ডাইট’ বাঁচাইয়া রেখেছিল দ্বিতীয়বার । পরে খবর নিয়ে শুনলাম, নুরুল আমিন সাহেব নাকি জেল সুপারেনটেনডেন্ট সাহেবকে বলে রেখেছিলেন যে আমাদের যেন কোনো খাওয়ার, থাকার কষ্ট না হয়। সেজন্য বোধহয় একটু যত্ন পেয়েছিলাম ।
পাকিস্তান হওয়ার পরে রাজবন্দিদের যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা ইংরেজ আমলে ছিল তাহা উঠাইয়া দেওয়া হয়। রাজবন্দিদের কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতো না। তাদের ব্যবহার করা হতো সাধারণ কয়েদিদের মতো। কাহাকেও তৃতীয় শ্রেণীর মতো ব্যবহার করত, আবার কাহাকেও প্রথম শ্রেণীর মতো ব্যবহার করত। আইবিদের ইচ্ছা আমার মনে আছে, এক এমবিবিএস ভদ্রলোক ডাক্তারকে তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি করে দুই বৎসর রাখা হয়েছিল। আমার এক ভাগ্নে মেডিকেল কলেজে পড়তো যাকে গ্রেপ্তার করে তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি করে জেলে রাখা হয়েছিল আমার চোখের সামনে।
ওর দিকে আমি চাইতে পারতাম না। দু’একবার জেল পালানো বা জেলের আইন মানে না, মারপিট করে—ডেঞ্জারাস কয়েদিদের রাখা হতো যেখানে সেই জেলে তাকেও রাখা হয়েছিল। আমাকেও দুই-চারবার এই সমস্ত সেলে থাকতে হয়েছে । তাই রাজবন্দিরা মেডিকেল ডাইট না পেলে তাদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু সকল সময় তাদের কপালে তা জুটতো না। হাসপাতালে রাজবন্দিদের ভর্তি করলে তাড়াতাড়ি রোগ ভাল হোক আর খারাপ হোক, সেদিকে খেয়াল না করে তাড়াইয়া দেওয়া হতো। ডাক্তাররা ইচ্ছা করলে কয়েদিদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। যত রকম রোগ আমরা সাধারণ মানুষ জানি তা জেলখানায় আছে। টিবি রোগীকেও রাখার ও চিকিৎসা করার বন্দোবস্ত জেলের ভেতর করা আছে।
সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
পড়ুন আগের পর্ব :
কারাগারের রোজনামচা : পর্ব-১৮
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী,এসজিএন