16 C
আবহাওয়া
১০:১৬ পূর্বাহ্ণ - ডিসেম্বর ২০, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » পরিবেশ দিবস : সচেতন না হলে আনোয়ারায়ও ঘটতে পারে বিস্ফোরণ

পরিবেশ দিবস : সচেতন না হলে আনোয়ারায়ও ঘটতে পারে বিস্ফোরণ


।। এনামুল হক নাবিদ ।।

বিএনএ, চট্টগ্রাম: আজ ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। চলমান এই সময়ে ইচ্ছেমত বিষাক্ত ক্যামিকেল ব্যবহার, নিরাপত্তাকে গুরুত্ব না দিয়ে বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ আদান-প্রদান ও জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে পরিবেশ যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠেছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ নানা কারণে চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ড উপজেলায়  দুই বার ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

জানা যায়, ২০২২ সালের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ৪ঠা জুন রাতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ১৩ জন দমকলকর্মীসহ ৫১ জন নিহত এবং দুই শতাধিক আহত হন। যাদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন।

এর পর ২০২৩ সালের ৪ মার্চ শুক্রবার বিকেলে একই উপজেলার ‘সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের’ প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের ফলে পরবর্তীতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এই ঘটনায় ৭ জন নিহত হন। সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় অবস্থিত একটি বেসরকারি অক্সিজেন প্ল্যান্টে এ ঘটনা ঘটে।

দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের উত্তর জেলার সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলার পর সব চেয়ে বেশি কারখানা ও ইন্ড্রাস্ট্রি রয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশ পথ আনোয়ারা- কর্ণফুলী উপজেলায়। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড ( সিইউএফএল), কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড, ইউনাইটেড বিদ্যুৎকেন্দ্র, ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সার কারখানা, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) ও কোরিয়ান ইপিজেড কারখানাগুলোতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আগে কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো ও সচেতনতার সাথে কারখানা পরিচালনার দাবি তুলেছেন স্থানীয় জনসাধারণ ও সচেতন মহল। সচেতন মহল ও পরিবেশবিদরা মনে করছেন সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণ গুলোতে যে  ট্রাজেডি সৃষ্টি হয়েছে সেখান থেকে শিক্ষা না নেয় তাহলে আনোয়ারায় ঘটতে পারে লেবাননের বৈরুত কিংবা সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণের মত ঘটনা। যে বিপর্যয় রোধ করা অসম্ভব হবে।

রসায়নবিদদের মতে, ইউরিয়া উৎপাদনে প্রায় ১২০-১৩০ এটিএম চাপে ও ১৮০-১৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এনএইচ৩ ও সি০২ গ্যাসের বিক্রিয়ায় প্রথমে অ্যামোনিয়াম কারামেট এবং পরে এটি “নিদিত হয়ে ইউরিয়া উৎপন্ন করে। অ্যামোনিয়াম উৎপাদনে নাইট্রাজেন ও হাইড্রোজেনে ১:৩ অনুপাতের মিশ্রণটিকে ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তপ্ত এফই চূর্ণ ও প্রভাবক সহায়ন এ ১২০৩ মিশ্রণের ওপর দিয়ে ২০০ এটিএম চাপে চালনা করলে হেবার পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়, এবং অ্যামোনিয়াম থেকে সি০২ এর বিক্রিয়া করে ইউরিয়া সার  তৈরি হয়। 

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি-১) সার কারখানায় একটি অ্যামোনিয়া গ্যাসের ট্যাংক ছিদ্র হয়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে ট্যাংকটি অন্তত ৫০ ফুট দূরে উড়ে গিয়ে পড়ে। এতে নির্গত হয়ে যায় ট্যাংকের প্রায় ৪০০ টন অ্যামোনিয়া গ্যাস। ফলে আনোয়ারা উপজেলাসহ আশপাশের পতেঙ্গা, হালিশহর, ইপিজেড, আগ্রাবাদ পর্যন্ত প্রায় কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গন্ধযুক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাস। এতে অ্যামোনিয়ার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় দুই শতাধিক মানুষ শ্বাসকষ্টে  হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আশপাশের নদী, পুকুর ও জলাশয়ের মাছ ও পশু-পাখিসহ মারা যায় বিপুল সংখ্যক প্রাণী। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্ষেতের ফসল। বিবর্ণ হয়ে পড়ে গাছপালা। চলতি বছরের গত ২৪ এপ্রিল চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) এর বর্জ্যের বিষাক্ত পানি পান করে ১৩ মহিষের মৃত্যু ঘটে। এর আগে, ১৪ এপ্রিল ৪টি এবং সর্বশেষ ৬ মে ৮টি মহিষের মৃত্যু হয়। এভাবে প্রতিবছর সিইউএফএল এর বর্জ্যের বিষাক্ত পানি খেয়ে অনেক গবাদিপশু মারা যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়  ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি সায়েন্স বিভাগের সাবেক   অধ্যাপক ড. কামাল হোসেন বলেন, ইউরিয়া উৎপাদনে যে রাসায়নিক ব্যবহার হয় তা এমনিতে পরিবেশের জন্য বিপর্যয়, যা ইটিপি প্লান্টের মাধ্যমে পরিশোধন করতে হয়। তা না হলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় হয়। এসব কারখানাতে যে রাসায়নিক মজুদের ডিপো বা সঞ্চালন লাইন রয়েছে তা যদি দুর্ঘটনা রোধে সক্ষম না হয় তাহলে যে কোন সময় বড় বিপর্যয় ঘটবে। এমনিতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিজে কোনো বিস্ফোরক পদার্থ নয়, তবে বিশেষ কিছু অবস্থায় তা বিস্ফোরকে পরিণত হতে পারে। তখন যে বিপর্যয় হবে তা বৈরুত কিংবা সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণের থেকে ভয়াবহ হবে। এজন্য কর্তৃপক্ষকে এখন থেকে সর্তক থাকতে হবে। তা না হলে এসব কারখানাতে যে কোনো সময় মারাত্মক বিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এম এ কাইয়ুম শাহ সীতাকুণ্ড ট্রাজেডির কথা উল্লেখ করে বলেন, ভয় হয় প্রাণের আনোয়ারা কখন সীতাকুণ্ড হয়! আমরা আর লাশ দেখতে চাই না, চাইনা শত মায়ের বুক খালি হোক।  বিস্ফোরণ হওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চাই না, আমরা চাই দুর্ঘটনা ঘটার আগে আপনারা পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। নয়তো আবার লাশের মিছিল দেখতে হবে।

তিনি বলেন, সিইউএফএল, ড্যাপ-১, ড্যাপ-২ ও কাফকোসহ আনোয়ারায় অবস্থিত সকল কারখানাগুলোকে নজরদারীর মধ্যে এনে যে কোনো দুর্ঘটনা রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানান। তিনি বলেন আমার মনে হয় এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের তেমন নজরদারি করার সুযোগ থাকে না। আমার মনে হয় পরিবেশের যে নিয়ম কানুন থাকে তা তারা যথাযথ মানে না।  না হয় তাদের যে ইটিপি প্ল্যান রয়েছে সে গুলোর মাধ্যমে পানি শোধনাগার না করার কারণে এখানে মাছ ও গবাদিপশু প্রতিনিয়ত মরে যাচ্ছে। সেখান থেকে যেটা বুঝা যায়, তারা পরিবেশের আইন মানে না বা গুরুত্ব দেয় না। ভয় হয় এই খামখেয়ালির কারণে যদি কোন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে তাহলে আমরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমি বলব পরিবেশ অধিদপ্তর আগে থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

নিরাপত্তার বিষয়ে আনোয়ারায় অবস্থিত এসব কারখানারগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, কারখানার নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে আমরা খুবই সচেতন রয়েছি। বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেডে (সিইউএফএল) প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা শাখার প্রধান  আব্দুর রহমান  বলেন, আমরা কারখানার নিরাপত্তায় শতভাগ প্রস্তুত থাকি। কোন বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ড যাতে না ঘটে সে জন্য সার্বিক ব্যবস্থা নেয়া থাকে। এর জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানে ফায়ার এন্ড সেফটি বিভাগ রয়েছে। 

কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড) কর্পোরেশন (বিডি) লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক মোঃ মুশফিকুর রহমান বলেন, নিরাপত্তা আমাদের মূল বিষয়। আমরা ক্যামিকেল ব্যবহার এবং এর নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করেছি।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, আসলে সব প্রতিষ্ঠানের ক্যামিকেল ব্যবহারটা তাদের  ফ্যাক্টরি বা কোন সিস্টেমে তারা ব্যবহার করছে তার উপর নির্ভর করবে। তবে আমরা এসব প্রতিষ্ঠান গুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করি। আসলে এই কারখানা গুলো ক্যামিকেল ব্যবহারে তাদের সক্ষমতা নিশ্চিত করে কারখানা চালু করে। 

বিএনএনিউজ/ নাবিদ/ এইচ.এম/হাসনা

Loading


শিরোনাম বিএনএ