29 C
আবহাওয়া
২:২৭ অপরাহ্ণ - নভেম্বর ১৫, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » রাসুলুল্লাহ(দ.)-র অবমাননার প্রতিবাদ করা প্রত্যেক ঈমানদারের ফরজ দায়িত্ব

রাসুলুল্লাহ(দ.)-র অবমাননার প্রতিবাদ করা প্রত্যেক ঈমানদারের ফরজ দায়িত্ব

রাসুলুল্লাহ(দ.)-র অবমাননার প্রতিবাদ করা প্রত্যেক ঈমানদারের ফরজ দায়িত্ব

।।সিরাজুল আরেফিন চৌধুরী।।

একেবারে ইসলামের প্রাথমিক সময়ের কথা। এখন পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ (দ.) প্রকাশ্যে আল্লাহর বাণী প্রচার আরম্ভ করেন নাই। অল্প কয়েকজন মাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছেন। একদা আল্লাহ নাজিল করলেন وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ অর্থাৎ আপনি আপনার নিকট আত্মীয়দের সতর্ক করুন (সুরা আশ-শু’আরা, আয়াত-২১৪) । তখন রাসূলুল্লাহ (দ.) সাফা পর্বতে তাশরিফ নিয়ে গেলেন, কুরাইশের লোকজনকে আহবান করে একত্রিত করলেন। সমবেত লোকজনকে রাসূলুল্লাহ (দ.) বললেন- আমি যদি তোমাদের বলি পাহাড়ের পেছনে একদল অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনী তোমাদেরকে হামলা করার জন্য উদ্যত হয়ে আছে, তোমরা কি বিশ্বাস করবে? তারা বলল- আপনি সত্যবাদী, কখনো মিথ্যা বলেন নাই। তখন রাসূলুল্লাহ (দ.) আল্লাহর একত্ববাদ (তাওহীদ) ও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল হওয়ার (রিসালাত)-র কথা প্রকাশ করলেন।

আবু লাহাব রেগে উঠে হাত নেড়ে বলল- তুমি ধ্বংস হও, এজন্যই কি আমাদেরকে ডেকেছো? তখন আল্লাহতায়ালা নাযিল করলেন

فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِنْ مَسَدٍ (৫ ) وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ (৪)     سَيَصْلَى نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ (৩) مَا أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ (২)- تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ (১)

অর্থাৎ ধ্বংস হয়ে যাক আবু লাহাবের দুই হাত এবং সে ধ্বংস হয়েই গেছে। তার সম্পদ ও উপার্জন তার কোন কাজে আসেনি। অচিরেই সে প্রবেশ করবে লেলিহান আগুনে। এবং তাকে ইন্ধনকারীনী তার স্ত্রী, লাকড়ির বোঝা বহনকারিনীও। তার গলায় খেজুর বাকলের রশি (সুরা লাহাব)।

আল্লাহর রাসূল (দ.)-কে অবমাননা করায় সর্বপ্রথম স্বয়ং আল্লাহ সাথে সাথে এর প্রতিবাদ স্বরূপ একটি পরিপূর্ণ সূরা, সূরা লাহাব নাযিল করলেন। আল্লাহ ধ্বংস করে দিলেন আবু লাহাবকে। যে হাত নেড়ে সে রাসূল (দ.)-র সাথে ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছে আল্লাহ ঘোষণা করলেন- ধ্বংস হোক তার দুই হাত। বদরের যুদ্ধের সপ্তাহখানেক পরে কালো দানার রোগে আক্রান্ত হয়ে সে মরে ছিল। সংক্রামক ব্যাধি হওয়ায় তিন দিন পর্যন্ত তার লাশ পড়ে রইল, ফেটে দুর্গন্ধ বের হলো। পরে কিছু মজদুরের মাধ্যমে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। তার স্ত্রী জামিলাহ হুজুরের চলার পথে কাটা বিছিয়ে দিত যেন তিনি কষ্ট পান। সেও একদিন নিজের বোঝার রশি গলায় আটকে জঘন্যভাবে মরল। যেমনটি আল্লাহ ইতিপূর্বে ঘোষণা দিয়েছেন- তার গলায় খেজুর বাকলের রশি (সূরা লাহাব, আয়াত ৫)। রাসূলুল্লাহ (দ.)-র অবমাননা কারীদের শাস্তি এভাবেই আল্লাহ দেন।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ যত শাস্তির বর্ণনা দিয়েছেন তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কঠিন শাস্তি তাদেরই যারা হুজুর (দ.)-কে অবমাননা করে। পবিত্র কোরআনে কখনো তাদেরকে জারজ সন্তান, কখনো আবতার (নির্বংশ) বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন উতুল্লিম বা’দা জালিকা জানিম অর্থাৎ দুষ্টু প্রকৃতির জারজ (সূরা কালাম, আয়াত- ১৩)।

হুজুর (দ.)-র প্রতি বদনামী রটানো ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা প্রসঙ্গে এটি অবতীর্ণ হয়েছে। সে হুজুর (দ.)-র শানে বেয়াদবি করত। ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা প্রকৃতই জারজ সন্তান ছিল- যা তার মায়ের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণিত হয়েছিল। আলোচনার বাহুল্যতা পরিহারের জন্য এখানে পুরো ঘটনা বর্ণনা করা হলো না (বিস্তারিত জানতে কানজুল ইমান পৃ. ১৫৩১ দেখুন)। অন্য জায়গায় আল্লাহ রাসূল (দ.)-র অবমাননাকারীদের আবতার (নির্বংশ) বলেছেন (সূরা কাওসার, আয়াত- ৩)।

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে- নিশ্চয়ই যারা কষ্ট দেয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত দুনিয়া ও আখিরাতে এবং আল্লাহ তাদের জন্য লাঞ্ছনার শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন (সূরা আহযাব, আয়াত ৫৭)। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, মহান আল্লাহ হুজুরের অবমাননা প্রসঙ্গে বলেছেন- যারা কষ্ট দেয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অর্থাৎ হুজুরের অবমাননা শুধু হুজুরকে কষ্ট দেয় তা নয় বরং তা স্বয়ং আল্লাহকে কষ্ট দেয়ার শামিল। এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হুজুর (দ.)-র প্রতি কোন দোষ ত্রুটি আরোপের চেষ্টাকারী বা তিরস্কারকারী বা অন্য কোনভাবে কষ্ট দেয়ার অপচেষ্টা কারীদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি আরোপ করেছেন।

সম্মানিত পাঠক, মহান আল্লাহ প্রিয় হাবীবের জীবদ্দশায় বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোরআনের বাণী সমূহ নাযিল করেন। যখনই রাসুল (দ.)-কে অবমাননার চেষ্টা করা হয়েছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এটার জবাব দিয়েছেন কোরআনে পাকের মাধ্যমে। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাসুল (দ.)-র অবমাননার প্রতিবাদ করা- এটা মহান আল্লাহর শিক্ষা। শুধু তাই নয় আল্লাহর হাবিবের সামান্যতম অবমাননাও আল্লাহ সহ্য করেন না। যেমন আল্লাহ বলেন- يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقُولُواْ رَٰعِنَا وَقُولُواْ ٱنظُرۡنَا وَٱسۡمَعُواْۗ وَلِلۡكَٰفِرِينَ عَذَاب أَلِيمٞ অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ, রা-ইনা বলোনা এবং এভাবে আরজ করো হুজুর আমাদের প্রতি কৃপা দৃষ্টি রাখুন এবং প্রথম থেকে মনোযোগ সহকারে শোনো, অবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি (সুরা বাকারা, আয়াত-১০৪)। আরবি ভাষায় ‘রা-ইনা’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন।

সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ (দ.)-র ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন। কিন্ত ইহুদিদের ভাষায় শব্দটি গালি ছিল। তারা (ইহুদিরা) নবীজির ক্ষেত্রে উপহাস সূচক এটি ব্যবহার করত। হুজুর (দ.)-র সাহাবী হযরত সা’দ ইহুদিদের উদ্দেশ্যে বললেন- ভবিষ্যতে তোমরা এই শব্দ বললে আমি তোমাদের গর্দান উড়িয়ে দিব। কারণ তিনি ইহুদিদের ভাষা বুঝতেন। ইহুদীরা বলল, মুসলমানরাও এ শব্দ ব্যবহার করে থাকে। তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই আয়াত শরীফ নাযিল করলেন-যেন নবীজির শানে কেউ তিরস্কার করতে না পারে।

এখান থেকে প্রমাণিত হয় হুজুর (দ.)-র শানে মানহানিকর শব্দ ব্যবহার করা হারাম, যদিও মানহানির উদ্দেশ্য না থাকে। আর মানহানির উদ্দেশ্য থাকলে তা কুফর। এমনকি যে শব্দের অন্য কোন খারাপ অর্থ থাকতে পারে এমন শব্দ ব্যবহার না করার জন্য এ আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুমিনদের শিক্ষা দিয়েছেন।

হাদীস শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য নবীজিকে নিজের জীবনের চাইতে বেশি ভালবাসতে হবে। যেমন আব্দুল্লাহ বিন হিশাম থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। তিনি ওমর বিন খাত্তাব (রা.) এর হাত ধরেছিলেন, ওমর (রা.) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল- আপনি আমার জীবন ছাড়া সকল জিনিস থেকে আমার নিকট প্রিয়তম। একথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন ‘না’, সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ আছে, যতক্ষণ না আমি তোমার নিকট তোমার জীবন থেকেও প্রিয়তম হতে পেরেছি ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণ মুমিন হতে পারো না। ওমর (রা.) বললেন- এক্ষনে, আপনি আমার জীবন থেকেও প্রিয়তম। তখন রাসুল (দ.) বললেন, এখন হে ওমর, তোমার ঈমান পূর্ণ হয়েছে (সহীহ বুখারী শরীফ, খন্ড ২, হাদিস নং ৬১৭৮ পৃষ্ঠা ৯৮১)।

হুনাইনের যুদ্ধে গনিমতের মাল বন্টনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (দ.) কিছু নওমুসলিমকে ইসলামের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট করতে প্রাধান্য দিয়ে বাড়তি দ্রব্য দিলেন। এটি দেখে আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই ইবনে সুলুল (যুলখোরাইসা) নামে এক ব্যক্তি আপত্তি জানালো। সে বলল, আমাদের প্রতি ন্যায় বিচার হয়নি। এ কথা রাসূলুল্লাহ (দ.)-র দরবার-এ পৌঁছালে রাসুলুল্লাহ(দ.)-র চেহারা লাল বর্ণ হয়ে গেল। তারপর তিনি বললেন, যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ইনসাফ না করেন, আর কে ইনসাফ করবে? আল্লাহ মুসাকে রহম করুন। তাকে এর চেয়ে বেশি কষ্ট দেয়া হয়েছিল, কিন্ত তিনি ধৈর্য ধারণ করেছিলেন (সহীহ বুখারী ৩১৫০, মুসলিম ২৪৯৪)

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহর সাহাবী উক্ত অভিযোগকারী মুনাফিককে হত্যা করতে উদ্যত হলে রাসূলুল্লাহ (দ.) নিষেধ করলেন। কারণ এতে মানুষ বলবে উনি নিজের সঙ্গীদের হত্যা করেছেন, যদিও এটি হত্যা করার মত অপরাধ ছিল। এখান থেকে আমাদের নিকট যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় তা হলো- রাসুলুল্লাহ (দ.)-র শানে যারা বেয়াদবি করে সাহাবীগণ তাদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন ।

বিশ্বাসীদের জন্য যে বিষয়টি শিক্ষনীয় তা হল হুজুর (দ.)-র সামান্যতম মানহানি সহ্য করা যাবে না। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (দ.)-র সামান্যতম মানহানির জবাব দিয়েছেন এবং মুমিনদেরকেও তা শিক্ষা দিয়েছেন পবিত্র কোরআনের মাধ্যম। সুতরাং কারো দ্বারা রাসূলুল্লাহ (দ.)-র মানহানি করা হলে, রাসূলুল্লাহ (দ.)-কে নিয়ে কোন কটুক্তি, বিদ্রুপ, ঠাট্টা, উপহাস করা হলে সাথে সাথে এর প্রতিবাদ করা ঈমানদারের জন্য অপরিহার্য। যার মধ্যে সামান্য পরিমাণও আল্লাহ-রাসূলের উপর বিশ্বাস আছে তিনি রাসুলুল্লাহ (দ.)-র অবমাননা সইতে পারবেন না বরং সাথে সাথে তীব্র প্রতিবাদ জানাবেন। এটাই রাসূল (দ.)-র সাহাবাগণের আদর্শ।

সম্প্রতি ভারতের মহারাষ্ট্রের এক হিন্দু পুরোহিত রাসূল (দ.)-কে কটুক্তি করে এবং বিজেপির এক নেতা তাকে সমর্থন করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ভারতের মুম্বাইয়ে লক্ষ লক্ষ মুসলিম জড়ো হয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ এবং ওই ব্যক্তির উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছে। আমরাও ভারতীয় মুসলমান এবং বিশ্ব মুসলমানদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে রাসূল (দ.)-র অবমাননার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং সাথে সাথে সেই নিকৃষ্টতম ব্যক্তির উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

কারণ রাসূলুল্লাহ (দ.)-র সামান্যতম অবমাননাও কোন ঈমানদার মুসলমান সহ্য করতে পারে না! রাসূলুল্লাহ (দ.)-কে সম্মান করা- এটি প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজের ওপর ফরজ দায়িত্ব এবং এটি আমাদের ঈমানের অংশ।

লেখক :
সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)

Loading


শিরোনাম বিএনএ